আজ আমার আলোচনা করবো বিভিন্ন “ভিটামিনের উৎস, তাদের কাজ এবং অভাবজনিত লক্ষন” সম্পর্কে।
ভিটামিন কি?
যে বিশেষ জৈব পরিপোষক সাধারণ খাদ্যে অতি অল্প পরিমাণে থাকে, দেহের স্বাভাবিক ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এবং রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে তাকে ভিটামিন বলে।
“ভিটামিন” নামকরণ
বিজ্ঞানী হপকিন্স এই খাদ্য উপাদান অত্যাবশ্যকীয় সহায়ক খাদ্য উপাদান নামে অভিহিত করেন। বিজ্ঞানী ক্যাসিমির ফ্রাঙ্ক 1911 খ্রিস্টাব্দে এই খাদ্য উপাদান কে ভিটামিন নামে অভিহিত করেন।
অ্যান্টিভিটামিন কী?
যে সকল পদার্থ ভিটামিন এর অনুরূপ রাসায়নিক শ্রেণী ভুক্ত হয়েও ভিটামিনের কার্যকারিতা হ্রাস বা বিনষ্ট করে। তাদের অ্যান্টি ভিটামিন বলে। যেমন পাইরিথিয়ামিন থিয়ামিনের, গ্যালাক্টোফ্লাভিন রাইবোফ্লাভিন এর
প্রোভিটামিন কী?
যেসকল জৈব যৌগ থেকে প্রাণী দেহে ভিটামিন সংশ্লেষিত হয়। তাদের প্রো ভিটামিন বলে। যেমন প্রো ভিটামিন D2 (আর্গোস্টেরল) ভিটামিন D2 এর প্রোভিটামিন।
সিউডোভিটামিন কী?
যেসকল জৈব যৌগের গঠন ভিটামিনের গঠন সদৃশ কিন্তু ভিটামিনের গুণসম্পন্ন নয়। তাদের সিউডোভিটামিন বলে যেমন মিথাকোবালামিন ভিটামিন B12 ভিটামিন।
অ্যাভিটামিনোসিস কী? = ভিটামিনের অভাব কে বলে অ্যাভিটামিনোসিস।
হাইপোভিটামিনোসিস কী? = দেহের স্বাভাবিকের চেয়ে কম ভিটামিন থাকলে। তাকে বলে হাইপোভিটামিনোসিস।
হাইপারভিটামিনোসিস কী? = দেহের স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভিটামিন থাকলে। তাকে হাইপারভিটামিনোসিস বলে।
ভিটামিনের শ্রেণীবিভাগ
দ্রাব্যতা অনুসারে ভিটামিন কে দুই ভাগে ভাগ করা হয় 1) তেলে বা স্নেহ পদার্থে দ্রবণীয় ভিটামিন-A, D, E, K; 2) জলে দ্রবণীয় ভিটামিন-B, C , P
[আরও পড়ুন : মানব হৃৎপিন্ডের সম্পূর্ণ বিবরণ ও হৃৎপিণ্ড রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি বর্ণনা। (Blood circulation of heart)]
ভিটামিন A বা রেটিনল
ভিটামিন A এর উৎস : হ্যালিবাট, হাঙ্গর, ইত্যাদি মাছের যকৃতের তেল, গাজর, ব্রোকলি পাতা, রাঙা আলু, পালং শাক, কুমড়ো, এছাড়া অন্যান্য শাকসবজি, মাখন, ডিম, দুধ।
ভিটামিন A এর শারীরবৃত্তীয় কাজ :
1) চক্ষুর কর্মক্ষমতা রক্ষা।
2) স্নায়ু কলার কর্মদক্ষতা প্রদান।
3) অস্থি ও দাঁতের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, পেশি গঠন ও কার্য নিয়ন্ত্রণ।
4) ত্বকের কোমলতা রক্ষা করা।
ভিটামিন A এর অভাবজনিত লক্ষণ :
1) চোখে ছানি পড়ে।
2) রাতকানা রোগ হয়।
3) ত্বক খসখসে গুটি যুক্ত হয় একে ফ্রিনোডার্মা বলে।
4) ক্যারাটোম্যালেশিয়া বা কর্নিয়া নষ্ট হয়।
ভিটামিন A অন্ধত্ব প্রতিরোধ করে একে অ্যান্টিজেরপথ্যালমিক ভিটামিন বলে।
ভিটামিন B কমপ্লেক্স
ভিটামিন B1 বা থিয়ামিন
ভিটামিন B1এর উৎস:
ডিমের কুসুম, ঢেঁকিছাটা চাল, দানাশস্যের খোসা, বাদাম, ডাল, ফুলকপি, লেটুস, গাজর ইত্যাদি।
ভিটামিন B1এর শারীরবৃত্তীয় কাজ: কার্বোহাইড্রেট বিপাক।
কলা কোষে ও মস্তিষ্কে শর্করার জারণ ঘটায়। প্রোটিন, স্নেহপদার্থ, কার্বোহাইড্রেট সংশ্লেষ করা।
ভিটামিন B1এর অভাবজনিত লক্ষণ:
1) সার্বিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয।
2) বেরিবেরি রোগ হয়। হাত পা ফোলে।
3) ক্ষুধামান্দ্য, স্নায়ুর দুর্বলতা,
4) হৃদপিন্ডের দুর্বলতা, ইত্যাদি দেখা যায়।
ভিটামিন B2 বা রাইবোফ্লাভিন।
ভিটামিন B2 এর উৎস:
যকৃত, ডিমের সাদা অংশ, দুধ, অঙ্কুরিত ছোলা, পালং শাক, দানাশস্য ইত্যাদি।
ভিটামিন B2 এর শারীরবৃত্তীয় কাজ:
1) দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি।
2) চামড়ার সুস্থতা রক্ষা।
3) শর্করাকে স্নেহ পদার্থে রূপান্তরিত করা।
ভিটামিন B2 এর অভাবজনিত লক্ষণ :
1) স্নায়ুতন্ত্র, চক্ষু, ত্বকের ক্ষয়।
2) স্টোমাটাইটিস হয়, চুল উঠে যায়, ত্বক অমসৃণ হয়।
3) এছাড়াও গ্লসাইটিস রোগ দেখা যায়।
ভিটামিন B3 বা নিয়াসিন
ভিটামিন B3 এর উৎস:
ডিমের কুসুম, মাছ, মাংস, দুধ, চালের গুঁড়ো দানাশস্যের খোসা, মটর ইত্যাদি।
ভিটামিন B3 এর শারীরবৃত্তীয় কাজ :
দেহের বৃদ্ধি,
কার্বোহাইড্রেটকে স্নেহ পদার্থে রূপান্তরিত করা।
বিপাকে ও কলা শ্বসনের সাহায্য করে,
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র উদ্দীপিত করা।
পেলেগ্রা রোগ প্রতিরোধ।
ভিটামিন B3 এর অভাবজনিত ফল :
সার্বিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়,
পেলেগ্রা রোগ হয়, তাই নিয়াসিনকে পেলেগ্রা প্রিভেনটিভ ফ্যাক্টর বলে।
খসখসে ত্বক,
খাদ্যনালীর জখম, রক্তাল্পতা, ওজন ও কর্মক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়।
ভিটামিন B 5 বা প্যানটোথেনিক অ্যাসিড
ভিটামিন B 5 এর উৎস:
ডিমের সাদা অংশ, যকৃত, মাংস, দুধ, চাল গুঁড়ো, আলু, মটর, ইত্যাদি।
ভিটামিন B 5 এর শারীরবৃত্তীয় কাজ :
বিপাক ক্রিয়ায় সাহায্য করে,
ত্বকের নমনীয়তা রক্ষা,
দেহের পুষ্টি ও সার্বিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করা,
ভিটামিন B 5 এর অভাবজনিত লক্ষণ :
পেশিতে টান,
পাখির পেরোসিস রোগ,
ইঁদুর, মুরগির ডার্মাটাইটিস রোগ ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়।
ভিটামিন B9 বা ভিটামিন M বা ফলিক অ্যাসিড।
ভিটামিন B9 এর উৎস:
ডিমের কুসুম, যকৃত, গম, ব্যাঙের ছাতা, সোয়াবিন, সবুজ শাকসবজি, ইত্যাদি।
ভিটামিন B9 এর শারীরবৃত্তীয় কাজ:
লোহিত কণিকা গঠন এবং এর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ,
DNA গঠন।
ভিটামিন B9 এর অভাব জনিত লক্ষণ: রক্তাল্পতা,
দেহের বৃদ্ধি হ্রাস,
মেগালোব্লাস্ট অ্যানিমিয়া দেখা যায়।
ভিটামিন B12 বা সায়ানোকোবালামিন
ভিটামিন B12 এর উৎস:
মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, স্টেপটোমাইসিস গ্রিসিয়াস ছত্রাক, শাকসবজিতে ভিটামিন B12 পাওয়া যায় না।
ভিটামিন B12 এর শারীরবৃত্তীয় কাজ :
দেহের বৃদ্ধি,
সামগ্রী রক্ত উৎপাদন,
নিউক্লিক অ্যাসিড উৎপাদন,
স্নায়ুতন্ত্র কর্মদক্ষতা রক্ষা।
ভিটামিন B12 এর অভাবজনিত লক্ষণ:
বৃদ্ধি ব্যাহত হয়,
পারনিসিয়াস অ্যানিমিয়া,
হাইপারগ্লাইসেমিয়া রোগ হয়।
ভিটামিন C বা অ্যাসকরবিক অ্যাসিড
ভিটামিন C এর উৎস:
প্রধানত আমলকি, পেয়ারা, পেঁপে, কাঁচা লঙ্কা, আঙ্গুর, পালংশাক, বিভিন্ন ফল এবং স্বল্প পরিমাণে মাতৃদুগ্ধে, প্রাণীর যকৃতের, দুধ, মাংস, মাছ, ইত্যাদি।
ভিটামিন C এর শারীরবৃত্তীয় কাজ:
কলা কোষে জারনে অংশগ্রহণ করে, কার্বোহাইড্রেট বিপাক,
দাত ও অস্থি গঠন,
পাকস্থলী ও রক্তবাহ কে সতেজ রাখা।
ভিটামিন C এর অভাবজনিত লক্ষণ :
স্কার্ভি রোগ হয়,
দাঁতের গোড়া ফুলে ওঠে,
ত্বকের নিচে অস্থিসন্ধিতে এবং মিউকাস পর্দায় রক্তক্ষরণ হয়,
রক্তাল্পতা দেখা যায়,
জনন ক্ষমতা হ্রাস পায়,
দাঁত ও অস্থির বিকৃতি ঘটে।
ভিটামিন D বা ক্যালসিফেরল
ভিটামিন D এর উৎস:
হ্যালিবাট, হাঙ্গর মাছের যকৃৎ তেল, দুধ, মাখন শাকসবজি, পর্যাপ্ত সূর্যালোকে মানুষের দেহত্বকে সংশ্লেষ হয়।
ভিটামিন D এর শারীরবৃত্তীয় কাজ:
ক্ষুদ্রান্তে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের শোষনে সাহায্য করে,
অস্থি ও দাঁতের গঠন,
পুষ্টি, দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটায়।
ভিটামিন D এর অভাবজনিত লক্ষণ:
অস্থি ও দাঁতের বিকৃত গঠন,
অমসৃণ ত্বক,
শিশুদের রিকেট, বড়দের অস্টিওম্যালেসিয়া রোগ হয়,
রিকেট রোগ প্রতিরোধ করে বলে একে অ্যান্টিরিকেটিক ভিটামিন বলে।
ভিটামিন E বা টেকোফেরল
ভিটামিন E এর উৎস :
ডিমের কুসুম, মাছ, মাংস, গম, সোয়াবিন, শাকসবজি, ইত্যাদি।
ভিটামিন E এর শারীরবৃত্তীয় কাজ:
দেহের অবাঞ্ছিত জারন রোধ,
পেশি, জনন অঙ্গের স্বাভাবিক বৃদ্ধি,
গর্ভধারণ ও প্রসব নিয়ন্ত্রণ।
ভিটামিন E এর অভাবজনিত লক্ষণ:
পেশির বৃদ্ধি ব্যাহত হয়,
বন্ধ্যাত্ব, ভ্রুনের অকাল মৃত্যু,
অকাল প্রসব।
ভিটামিন K বা ফাইলোকুইনন
ভিটামিন K এর উৎস :
শাকসবজি, সোয়াবিন, পার্সলে পাতা, টমেটো, পালং শাক, সর্ষে শাক, ফুলকপি, সামুদ্রিক মাছ, ডিম, দুধ, মাংস, ইত্যাদি।
ভিটামিন K এর শারীরবৃত্তীয় কাজ :
প্রোথ্রম্বিন সৃষ্টি করে রক্ত তঞ্চনে সাহায্য করে।
ভিটামিন K এর অভাবজনিত লক্ষণ:
রক্ত চলাচল ক্ষমতা হ্রাস পায়,
রক্তক্ষরণ ঘটে,
রক্ত তঞ্চন জনিত সমস্যা দেখা যায়,
হাইপোপ্রোথ্রম্বিনেমিয়া দেখা যায়,
ভিটামিন K রক্ততঞ্চনবিরোধী বা অ্যান্টি হেমোরেজিক ভিটামিন বলা হয়।
Pingback: ইন সিটু সংরক্ষণ কাকে বলে ? | এক্স সিটু সংরক্ষণ কাকে বলে? – Studious
Pingback: বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, তাদের উৎস ও অভাবজনিত ফল – Studious