হ্যালো বন্ধুরা, আমরা এসে গেছি আমাদের আজকের নতুন বিষয় “রক্ত ও রক্তকণিকা” সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে । আশা করি পোস্টটি আপনাদের খুব ভাল লাগবে।
রক্ত কি?
রক্তরস বা প্লাজমা ও রক্তকণিকা (লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা, অনুচক্রিকা) নিয়ে গঠিত যে তরল যোগকলা প্রাণীদেহে শ্বাসবায়ু পরিবহন, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা, দেহে স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখে, ইত্যাদি কাজে অংশগ্রহণ করে তাকে রক্ত বলে।
রক্তের বৈশিষ্ট্য
1) রক্ত একরকমের তরল যোগকলা।
2) রক্তে কোষীয় উপাদান ধাত্রের তুলনায় কম থাকে।
3) রক্ত ইষৎ লবণাক্ত।
4) রক্ত ক্ষার প্রকৃতির হয়। PH-7.4।
5) মাছ, উভচর, সরীসৃপ প্রাণীদের রক্ত শীতল এবং পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের রক্ত উষ্ণ।
রক্তের উপাদান (components of Blood)
মানবদেহের রক্ত শতকরা 55 ভাগ রক্ত রস অর্থাৎ প্লাজমা এবং শতকরা 45 ভাগ রক্তকণিকা নিয়ে গঠিত।
এখন আমরা আলোচনা করবো মানবদেহের বিভিন্ন রক্ত কণিকা, তাদের আকার-আয়তন, গঠন ও বিভিন্ন কাজ সম্পর্কে।
লোহিত রক্তকণিকা বা এরিথ্রোসাইট কি?
হিমোগ্লোবিন নামে শ্বাস-রঞ্জক যুক্ত, অক্সিজেন পরিবহনে সক্ষম লাল রক্তকণিকাকে লোহিত রক্তকণিকা বলে।
লোহিত রক্তকণিকার আকার= মানুষের লোহিত রক্তকণিকা দ্বি-অবতল,গোলাকার হয়। পরিণত লোহিত কণিকায় নিউক্লিয়াস না থাকায় লোহিত কণিকা দ্বি-অবতল হয়। দ্বি-অবতল আকৃতির জন্য এদের তলীয় ক্ষেত্রফল অনেক বেশি হয়, ফলে এরা বেশি অক্সিজেন এর সংস্পর্শে আসতে পারে। অপরপক্ষে, নিউক্লিয়াস না থাকায় পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন থাকতে পারে , ফলে বেশি পরিমাণ অক্সিজেন পরিবহন করতে পারে।
লোহিত রক্তকণিকার আয়তন= লোহিত কণিকার গড় ব্যাস 7.2 মাইক্রোমিটার।
লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা= একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের প্রতি ঘন মিলিমিটার বা মাইক্রোলিটার রক্তে লোহিত কণিকার সংখ্যা হল গড়ে 5 মিলিয়ন এবং প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীলোকেদের রক্তে লোহিত কণিকার সংখ্যা হল 4.5 মিলিয়ন।
লোহিত রক্তকণিকার গঠন= প্রতিটি লোহিত কণিকা একটি লাইপো প্রোটিন নির্মিত কোষঝিল্লি পরিবেষ্টিত থাকে। কোষঝিল্লির মধ্যে ধাত্র বা স্ট্রোমা থাকে। ধাত্রে হিমোগ্লোবিন, প্রোটিন ও লিপিড থাকে। মানুষের পরিণত লোহিত কণিকায় নিউক্লিয়াস থাকে না। ব্যতিক্রম ব্যাঙ।
লোহিত রক্তকণিকার উৎপত্তি= ভ্রুণ অবস্থায় ভ্রূণের ভ্যাসকুলোসা অঞ্চল থেকে এবং জন্মের এক মাস পর্যন্ত যকৃত ও প্লীহা থেকে লোহিত কণিকা সৃষ্টি হয়। জন্মের পর লোহিত কণিকার আদর্শ উৎপত্তিস্থল লাল অস্থিমজ্জা। লাল অস্থিমজ্জার হিমোসাইটোব্লাস্ট কোষ থেকে লোহিত রক্ত কণিকা সৃষ্টি হয়।
লোহিত রক্তকণিকার জীবনকাল= লোহিত রক্তকণিকার গড় আয়ু 120 দিন
লোহিত রক্ত কণিকার কাজ:
লোহিত রক্ত কণিকার প্রধান কাজ গুলি হল-
1) অক্সিজেন কার্বন-ডাই-অক্সাইড পরিবহনের সাহায্য করা।
2) রক্তের সক্রিয়তা বজায় রাখা।
3) অম্ল বা ক্ষার সমতা বজায় রাখা।
4) রক্তের পজেটিভ বা ধনাত্মক ও নেগেটিভ বা ঋণাত্মক আয়নের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করা।
**রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া কী?
রক্তের লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে গেলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে রক্তাল্পতা অ্যানিমিয়া বলে।
শ্বেত রক্তকণিকার বা লিউকোসাইট কী?
রক্তে অবস্থিত নিউক্লিয়াস যুক্ত, বর্ণহীন অনিয়তাকার রক্তকণিকা দের শ্বেত রক্তকণিকা বা লিউকোসাইট বলে।
শ্বেত রক্তকণিকার আকার= শ্বেত রক্তকণিকার নির্দিষ্ট আকার নেই। কোন কোন শ্বেত রক্তকণিকা দেখতে অনেকটা অ্যামিবার কত হয়।
শ্বেত রক্তকণিকার আয়তন= শ্বেত রক্তকণিকার ব্যাস নির্দিষ্ট থাকে না। এদের ব্যাস 8-18 মাইক্রোমিটার হয়।
শ্বেত রক্তকণিকার সংখ্যা= প্রতি মিলিমিটার রক্তে শ্বেত কণিকার সংখ্যা হল 6000-8000
শ্বেত রক্তকণিকার গঠন= প্রতিটি শ্বেত কণিকা লাইকো-প্রোটিন নির্মিত কোষঝিল্লি পরিবেষ্টিত থাকে। সাইটোপ্লাজমের মধ্যে নিউক্লিয়াস উপস্থিত থাকে। নিউক্লিয়াস গোলাকার আকৃতির এবং কয়েকটি খন্ড বিশিষ্ট হয়। সাইটোপ্লাজম দানাযুক্ত বা দানাবিহীন আঙ্গানু থাকে।
শ্বেত রক্তকণিকার উৎপত্তিস্থল= শ্বেত রক্তকণিকা অস্থিমজ্জা এবং লসিকা পিণ্ড থেকে সৃষ্টি হয়। শ্বেত রক্ত কণিকার মাতৃকোষ গুলি হল মায়ালোব্লাস্ট, লিম্ফোব্লাস্ট, মনোব্লাস্ট।
শ্বেত রক্তকণিকার জীবনকাল= শ্বেতকণিকা গড় আয়ু 1 থেকে 15 দিনে হয়।
শ্বেত রক্তকণিকার পরিণতি= শ্বেত রক্তকণিকা রক্তসংবহনে বিনষ্ট হয়। R.E কোষ দ্বারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।
শ্বেত রক্তকণিকার শ্রেণীবিন্যাস= সাইটোপ্লাজমের দানার উপস্থিতির উপর নির্ভর করে শ্বেত রক্তকণিকাদের দুই ভাগে ভাগ করা হয় যথা-
গ্রানুলোসাইট বা দানাযুক্ত শ্বেত রক্তকণিকা এবং অ্যাগ্রানুলোসাইট বা দানাবিহীন শ্বেত রক্তকণিকা।
গ্রানুলোসাইট শ্বেতকণিকা তিন রকমের নিউট্রোফিল, ইউসিনোফিল, বেসোফিল। অ্যাগ্রানুলোসাইট শ্বেত রক্তকণিকা দুই রকমের যথা- মনোসাইট, লিম্ফোসাইট।
শ্বেত রক্তকণিকার কাজ=
শ্বেত রক্ত কণিকার প্রধান কাজ গুলি হল-
1) অ্যান্টিবডি উৎপাদন= লিম্ফোসাইট শ্বেত রক্তকণিকা অ্যান্টিবডি উৎপন্ন করে। বিশেষত ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমনের বিরুদ্ধে দেহের প্রতিরক্ষার কাজে নিযুক্ত থাকে।
2) হেপারিন নিঃসরণ= বেসোফিল শ্বেত রক্তকণিকা হেপারিন নিঃসরণ করে রক্তবাহে রক্ত তঞ্চন রোধ করে।
3) অ্যালার্জি প্রতিরোধ= ইউসিনোফিল শ্বেত রক্তকণিকা হিস্টামিন নিঃসরণ করে দেহের অ্যালার্জি প্রতিরোধ করে।
4) ট্রিফোন সৃষ্টি= মনোসাইট শ্বেত রক্তকণিকা প্লাজমা প্রোটিন থেকে ট্রিফোন নামে রাসায়নিক পদার্থ সৃষ্টি করে, কলা কোষে পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
অনুচক্রিকা বা থ্রম্বোসাইট কি?
রক্ত তঞ্চনে সাহায্যকারী নিউক্লিয়াস বিহীন রক্তকণিকা কে অনুচক্রিকা বা প্লেটলেট বা থ্রম্বোসাইট বলে।
অনুচক্রিকার আকার= অনুচক্রিকা আকারে গোলাকার, ডিম্বাকার এবং বেম আকৃতি বিশিষ্ট হয়।
অনুচক্রিকার আয়তন= প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তের অনুচক্রিকা সংখ্যা হল 2.5 লক্ষ থেকে 5 লক্ষ।
অনুচক্রিকার গঠন= অনুচক্রিকা হল প্রোটিন নির্মিত, পর্দা বিশিষ্ট ডিম্বাকার রক্ত কণিকা এবং এর সাইটোপ্লাজমে নিউক্লিয়াস থাকে না। অনুচক্রিকার সাইটোপ্লাজমে গলগী বডি, মাইটোকনড্রিয়া, এবং 50-100 দানা থাকে।
অনুচক্রিকার উৎপত্তি= অনুচক্রিকা লাল অস্থিমজ্জার মেগাক্যারিওসাইট থেকে সৃষ্টি হয়।
অনুচক্রিকার পরিণতি= প্লীহা ও R.E কোষে এরা বিনষ্ট হয়।
অনুচক্রিকার জীবনকাল= অনুচক্রিকার গড় আয়ু 3 দিন।
অনুচক্রিকার কাজ=
1) অনুচক্রিকার প্রধান কাজ হল রক্ত তঞ্চনে সাহায্য করে রক্ত ক্ষরণের সময় অনুচক্রিকা থ্রম্বোপ্লাস্টিন নিঃসরণ করে প্রোথ্রম্ববিনকে থ্রম্ববিনে পরিণত করে।
2) অনুচক্রিকা রক্তজালিকার ক্ষতিগ্রস্ত অন্তঃআবরণীর গায়ে এটে গিয়ে মেরামতির কাজকে দ্রুততর করে।
মানবদেহে রক্ত কণিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য
1) প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে 25 শতাংশ হ্রাস পেলে অলিগোসাইথেমিয়া দেখা যায়।
2) শ্বেতকণিকার সংখ্যা যখন বেড়ে প্রতি মাইক্রোলিটারে 20000 থেকে 30000 হয়।তখন তাকে লিউকোসাইটোসিস বলে। তবে শ্বেত কণিকার সংখ্যা যদি প্রতি মাইক্রোলিটারে 50000 থেকে 100000 হয় তাহলে তাকে ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া বলে।
3) হিমোসাইটোমিটার যন্ত্রের সাহায্যে লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা গণনা করা হয়।
4) মানুষের পরিণত লোহিত রক্তকণিকা নিউক্লিয়াসবিহীন হয়। তবে ব্যাঙের পরিণত লোহিত রক্ত কণিকা নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়।
5) অনুচক্রিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কম হলে সেই অবস্থাকে বলে থ্রম্বোসাইটোপিনিয়া। অনুচক্রিকার সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় হলে সেই অবস্থাকে বলে থ্রম্বোসাইটোসিস।
6) লোহিত রক্তকণিকার থিতানো হারকে এরিথ্রোসাইট সেডিমেনটেশন রেট আর ESR বলে।
7) রক্তে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা প্রতি মাইক্রোলিটারে 65 লক্ষের বেশি হলে সে অবস্থাকে বলা হয় পলিসাইথেমিয়া।
8) অতিমাত্রায় লোহিত রক্তকণিকা নষ্ট হলে রক্তাল্পতা দেখা যায়। সিকল সেল অ্যানিমিয়া, ফ্যামিলিক হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া, মেডিটেরানিয়ান অ্যানিমিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের রক্তাল্পতার উদাহরণ।
9) লোহিত রক্তকণিকা যখন কোষের সাইটোপ্লাজম অপেক্ষা কম ঘনত্বের দ্রবণ অবস্থান করে। তখন এর মধ্যে জল প্রবেশ করায় লোহিত রক্তকণিকা ফুলে ওঠে ও হিমোগ্লোবিন নির্গত হয় এই প্রক্রিয়াকে হিমোলাইসিস বলা হয়।
10) হিমোসাইটোব্লাস্ট থেকে লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে গুলিকে সাহায্যকারী পদার্থ, যেমন ফলিক অ্যাসিড, খনিজ লবণ, পিত্তলবন ইত্যাদির অভাব দেখা দিলে যে রক্তাল্পতা পরিলক্ষিত হয় তাকে পারনিসিয়াস অ্যানিমিয়া বা মেগালব্লাস্টিক রক্তাল্পতা বলে।
অলিগোসাইথেমিয়া এটা কোন বইয়ের তথ্য।?কাইন্ডলি ছবি সহ দিলে ভালো হতো। ধন্যবাদ এতো সুন্দর গুছিয়ে লেখার জন্য।
ধন্যবাদ আমাদের ব্লগ এ visit করার জন্য।