প্রত্যেক জীবদেহের দেহকোষে সবসময় নানারকম জৈবিক ক্রিয়া চলছে। এই জৈবিক ক্রিয়া গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য শক্তি প্রয়োজন। জীব খাদ্য গ্রহণ করে ওই শক্তি অর্জন করে। খাদ্যে থাকা স্থৈতিক শক্তি – যা সবুজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার সময় সৌরশক্তি থেকে উৎপন্ন হয়। জীবকোষে এই বিশেষ জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় খাদ্যে থাকা স্থৈতিক শক্তি তাপ শক্তি বা গতীয় শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই শক্তি ব্যয় করেই জীবদেহে সমস্ত রকম বিপাকীয় ও জৈবিক কাজগুলি সম্পন্ন হয়। যে প্রক্রিয়ায় খাদ্য স্থৈতিক শক্তি তাপশক্তি বা গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তাকে শ্বসন বা রেসপিরেশন বলে। শ্বসন এক ধরনের অপচিতি বিপাক।
শ্বসনের সংজ্ঞা
যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বা অনুপুস্থিতিতে খাদ্যের জারণের ফলে খাদ্য স্থৈতিকশক্তি গতি শক্তিতে রূপান্তরিত হয় ও মুক্ত হয় তাকে শ্বসন বলে।
শ্বসনের বৈশিষ্ট্য
1) শ্বসন একপ্রকার অপচিতি বিপাক। কারণ এই প্রক্রিয়ায় জটিল খাদ্যবস্তু সরল উপাদানে পরিণত হয় এবং দেহের শুষ্ক ওজন হ্রাস পায়।
2) শ্বসন একটি তাপমোচী প্রক্রিয়া ।
শ্বসন স্থান ও শ্বসন অঙ্গাণু
এককোষী থেকে বহুকোষী সমস্ত ধরনের জীব দেহের প্রতিটি সজীব কোষে শ্বসন দিনরাত ঘটে। শ্বসনের অধিকাংশ রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি মাইট্রোকন্ডিয়াতে ঘটায় মাইটোকনড্রিয়াকে কোষের শক্তিঘর বলা হয়।
শ্বসনে উৎপন্ন তাপ শক্তি ও ATP অনু
1 গ্রাম অনু গ্লুকোজ সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে প্রায় 668 কিলোক্যালরি তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। শ্বসনের গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় 2 অনু ATP এবং ক্রেবসচক্র প্রক্রিয়ায় 36 অনু ATP অর্থাৎ মোট 38 অনু ATP উৎপন্ন হয়।
শ্বসনের পদ্ধতি
গ্লাইকোলাইসিস:
এই প্রক্রিয়ায় কোষের সাইটোপ্লাজমে অক্সিজেনের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে উৎসেচকের প্রভাবে গ্লুকোজ আংশিকভাবে জারিত হয়ে 2 অনু পাইরুভিক অ্যাসিড এবং 2 অনু ATP উৎপন্ন হয়। এম্বডেন, মেয়ারহফ, এবং পারনেস নামক বিজ্ঞানী প্রথম এই প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করেন বলে গ্লাইকোলাইসিস পদ্ধতি EMP পথ নামে পরিচিত।
ক্রেবস চক্র:
এটি কোষের মাইট্রোকন্ডিয়ায় অক্সিজেনের উপস্থিতিতে ঘটে। ইংরেজ প্রাণ-রসায়নবিদ হ্যানস ক্রেবস 1937 খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম এই প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করেন বলে তাঁর নাম অনুসারে এই চক্রকে ক্রেবস চক্র বলে। এই পর্যায়ে পাইরুভিক অ্যাসিড সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, জল ও শক্তি উৎপন্ন করে। ক্রেবসচক্রে প্রথম উৎপাদিত জৈব যৌগটি হল সাইট্রিক অ্যাসিড যার মধ্যে 3টি কার্বক্সিল গ্রুপ থাকে। তাই ক্রেবসচক্রকে ট্রাই কার্বক্সিলিক অ্যাসিড চক্র বা TCA চক্র বলা হয়।
অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন= যে প্রক্রিয়ায় জৈব যৌগের জারণের ফলে উচ্চশক্তিসম্পন্ন ফসফেট যৌব অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট (ATP) সংশ্লেষিত হয়, তাকে অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন বলে। এটি মূলত মাইটোকনড্রিয়ায় সংঘটিত হয়।
শ্বসনের প্রকারভেদ
শ্বসন সাধারনত দুই প্রকারের হয়ে থাকে। সেগুলি হল 1) সবাত শ্বসন 2) অবাত শ্বসন
সবাত শ্বসন কাকে বলে?
যে শ্বসন পদ্ধতিতে বায়ুজীবী জীবকোষে শ্বসনবস্তু (গ্লুকোজ) মুক্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে জল ও কার্বন ডাই অক্সাইডে পরিণত হয় এবং শ্বসন বস্তুমধ্যস্থ স্থৈতিক শক্তি গতিশক্তি রুপে সম্পূর্ণরূপে নির্গত হয়, তাকে সবাত শ্বসন বলে।
এককোষী আমিবা থেকে শুরু করে উন্নত শ্রেণীর বহুকোষী উদ্ভিদ এবং প্রাণীদেহের প্রতিটি সজীব কোষে সবাত শ্বসন হয়। 1 গ্রাম অনু গ্লুকোজ থেকে 686 কিলোক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়াটি কোষের সাইটোপ্লাজম ও মাইট্রোকন্ডিয়া সংঘটিত হয়।
অবাত শ্বসন কাকে বলে?
যে শ্বসন পদ্ধতিতে অবায়ুজীবী জীবকোষে ( যে সকল জীবশ্বসনন ক্রিয়ার জন্য পরিবেশের মুক্ত অক্সিজেন গ্রহণ করে না। যেমন ডিনাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট, মনোসিস্টিস, কৃমি) মুক্ত অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে শ্বসনবস্তু (প্রধানত গ্লুকোজ) অক্সিজেন যুক্ত যৌগের (যেমন নাইট্রেট, কার্বনেট, সালফেট ইত্যাদি) অক্সিজেন কর্তৃক জারিত হয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ও জলে পরিণত হয় এবং শ্বসন বস্তুর মধ্যস্থ শক্তির আংশিক নির্গমন ঘটে, তাকে অবাত শ্বসন বলে 1 গ্রাম অনু গ্লুকোজ থেকে 50 কিলোক্যালোরি তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। এটি কোষের সাইটোপ্লাজম এর ঘটে।
বিভিন্ন প্রাণী ও তাদের শ্বাসঅঙ্গের নাম
প্রাণীর নাম | শ্বাসঅঙ্গের নাম |
অ্যামিবা, স্পঞ্জ, হাইড্রা | সমগ্রদেহতল |
কেঁচো,জোঁক | দেহত্বক। |
আরশোলা, প্রজাপতি, ফড়িং | 10 জোড়া শ্বাসছিদ্র এবং ট্রাকিয়া বা শ্বাসনালি |
মাছ, চিংড়ি, জলজ পতঙ্গ, শামুক | ফুলকা |
কই, মাগুর, সিঙি প্রভৃতি জিওল মাছের | ফুলকা অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্র |
মাকড়সা, কাঁকড়াবিছে | বুকলাঙ |
রাজকাঁকড়া | বুকগিল |
ব্যাঙাচি | বহিঃফুলকা |
ব্যাং | ফুসফুস, দেহতত্ত্ব, মুখবিবর গলবিলের মিউকাস পর্দা। শীত ঘুমের সময় ব্যাঙের দেহ ত্বকের সাহায্যে ত্বকীয় শ্বসন ঘটে। কারণ এই সময় ব্যাঙের ফুসফুসীয় শ্বসনের গতি কমে যায়। |
সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী, পক্ষী | ফুসফুস |
মানবদেহের শ্বসন প্রক্রিয়া
শ্বাসযন্ত্র গুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ
ফুসফুস= মানুষের ফুসফুস দুটি বক্ষপিঞ্জরের হৃৎপিণ্ডের দুপাশে এবং মধ্যচ্ছদার ওপরে অবস্থিত। ফুসফুস প্লুরা নামক আবরণ দিয়ে আবৃত থাকে। প্লুরা দুটি স্তরে বিন্যস্ত থাকে যথা-
1. ভিসেরাল প্লুরা (ফুসফুসকে বেষ্টন করে)
2. প্যারাইটাল প্লুরা (বক্ষপ্রাচীর সংলগ্ন)
উভয়ের মাঝখানে থাকে অন্তঃপ্লুরা অঞ্চল বা ইন্টার-পস্পেসল স্পেস যা এক প্রকার তরল দ্বারা পূর্ণ থাকে।
ব্রঙ্কাস= ফুসফুসের সঙ্গে যুক্ত ট্রাকিয়ার শাখা দুটিকে ব্রঙ্কাই বা ক্লোমশাখা বলে। ব্রঙ্কাসের শাখা প্রশাখা গুলিকে ব্রংকিওল বা উপ ক্লোমশাখা বলে। সূক্ষ্ম ব্রংকিওলের শেষ ভাগ স্থিত এবং জালক পরিবৃত হয়ে বায়ুথলি বা অ্যালভিওলাসে পরিণত হয়েছে।
ট্রাকিয়া= ফুসফুসের বাইরে ব্রঙ্কাস দুটি পরস্পর মিলিত হয়ে শ্বাসনালী বা ট্রাকিয়া (Trachea) গঠন করেছে।
ল্যারিংক্স= ট্রাকিয়ার সম্মুখভাগ ক্ষুদ্র নালীর সঙ্গে যুক্ত থাকে তাকে বাকযন্ত্র বা ল্যারিংক্স (Larynx) বলে। এর মধ্যে দুটি ভোকাল কর্ড থাকে, তাই এখানে স্বর সৃষ্টি হয়।
গ্লটিস= ল্যারিংক্সটি গলবিলের সঙ্গে একটি ছিদ্র দ্বারা উন্মুক্ত থাকে এই ছিদ্রটিকে গ্লটিস বা শ্বাসছিদ্র বলে। জিহ্বার গোড়ায় অবস্থিত তরুণাস্থি দ্বারা গঠিত ঢাকনা এপিগ্লটিস দিয়ে বন্ধ ও উন্মুক্ত হয়। খাদ্য গ্রহণের সময় এটিকে বন্ধ করায় এপিগ্লটিসের প্রধান কাজ।
নাসারন্ধ্র= আমাদের নাসিকাটি বাইরের দিকে যে দুটি ছিদ্রের দ্বারা মুক্ত তাকে বহিঃনাসারন্ধ্র (External nostrils) বলে। বহিঃনাসারন্ধ্র, মুখবিবরের দুটি ছিদ্র দিয়ে মুখবিবরে উন্মুক্ত হয় তাকে অন্তঃনাসারন্ধ্র (Internal nostrils) বলে।নাসাপথ মিউকাস এবং রোম আবৃত হওয়ার সময় ধুলোবালি ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে না।
বক্ষপিঞ্জর= এটি গৌণ শ্বাসযন্ত্র। বক্ষগহ্বরের দুপাশে 12 টি করে মোট 24 টি পঞ্জরাস্থি (Ribs) সামনের দিকে অবস্থিত উরঃফলকের সঙ্গে যুক্ত থেকে একটি খাঁচার আকার ধারণ করে, তাকে বক্ষপিঞ্জর (Thoracic cage) বলে। বক্ষপিঞ্জরের মধ্যে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস সুরক্ষিত থাকে।
উদ্ভিদের শ্বাসযন্ত্র
পত্ররন্ধ্র, লেন্টিসেল, শ্বাসমূল বা নিউম্যাটোফোর সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়। বিষমপৃষ্ঠ পাতা পাতাকে এবং সমাঙ্গপৃষ্ঠ পাতার উপরিতলে পত্ররন্ধ্র উপস্থিত থাকে গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের কান্ড থাকে ও ফলের ত্বকে লেন্টিসেল থাকে