নমস্কার বন্ধুরা, ইতিহাসের আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছি “ভারতীয় সংবিধান রচনার ইতিহাস“ সম্পর্কে, আজ আমরা শুরু করতে চলেছি ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য যেগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
♦ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য♦
ভারতীয় সংবিধানে এমন কতকগুলি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংবিধান থেকে ভারতীয় সংবিধানকে স্বাতন্ত্র দান করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধানের ত্রুটি – বিচ্যুতিগুলি বাদ দিয়ে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সর্বোৎকৃষ্ট বিষয়গুলি গ্রহণ করে ভারতীয় সংবিধান রচিত হয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড . দুর্গাদাস বসু বলেন যে, ভারতীয় সংবিধানের নানা বৈশিষ্ট্যগুলিই ভারতীয় সংবিধানকে বিশ্বের অন্যান্য সংবিধান থেকে পৃথক করেছে।
(১) ভারতীয় সংবিধান হল বিশ্বের বৃহত্তম লিখিত ও_জটিলতম সংবিধান। জন্মলগ্নেই এর আয়তন ছিল বিশাল। মােট ৩৯৫ – টি ধারা (Articles), বহু উপধারা ( Clauses ) এবং ৮ টি তফসিল (Schedules) নিয়ে এর সৃষ্টি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংশােধনের মাধ্যমে এর সঙ্গে ২ বিভিন্ন ধারা, উপধারা ও তালিকা যােগ হয়েছে।
বর্তমানে সংবিধানে ৪৪৮ টি ধারা এবং ১২ টি তফসিল আছে (অক্টোবর, ২০২১ পর্যন্ত)। এই সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির অধিকার ও সম্পর্ক, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলির ক্ষমতা, নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য , স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তৃত আলােচনা আছে। এইসব বিভিন্ন বিষয় এবং কেন্দ্র-রাজ্য ক্ষমতা বণ্টন ও পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ের আলােচনার ফলে ভারতীয় সংবিধান বিশ্বের অন্যতম জটিলতম সংবিধানে পরিণত হয়েছে।
(২) ভারতীয় সংবিধানের মূল প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে সংবিধানের ৪২ – তম সংশােধনের মাধ্যমে ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র ‘( ‘Sovereign Socialist Secular Democratic Republic ‘ ) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভারত একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র, কারণ ভারত নিজেই তার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করে-এ ব্যাপারে সে কারাে মতামত গ্রহণে বাধ্য নয়।
আরও পড়ুন:
♦ইউরোপীয় ধর্ম সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
♦ ভারতের গভর্নর জেনারেল, ভাইসরয় ও তাদের সময়কালের তালিকা
♦ অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি বলতে কি বোঝায়?
ভারত একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কারণ ভারত সরকার ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য দূর করার জন্য জমিদারি প্রথার বিলােপ, বিমা ও কতিপয় বৃহৎ ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ, রাজন্য ভাতার বিলােপ, জমির মালিকানার উর্ধ্বসীমা স্থিরীকরণ, ধনীর ওপর বিবিধ কর স্থাপন প্রভৃতি কতিপয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে । ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, কারণ ভারতের নাগরিকদের স্ব-ইচ্ছানুযায়ী ধর্মাচরণের অধিকার আছে এবং ভারত কোনাে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কারণ ভারতের জনগণ প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে থাকেন। ওই সব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই দেশের আইনসভা গঠিত হয় এবং এই আইনসভা দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়ােগ করে থাকে । ভারতবর্ষ একটি প্রজাতান্ত্রিক দেশ। এখানে কোনাে বংশানুক্রমিক রাজা বা রানির স্থান নেই। ভারতীয় শাসনব্যবস্থার শীর্ষে আছেন রাষ্ট্রপতি। তিনি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তিনি কোনােভাবে সংবিধান ভঙ্গ করলে বা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হলে তার কার্যকাল শেষ হবার আগেই তাকে অপসারিত করার ব্যবস্থা আছে।
(৩) ভারতীয় সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্রের সঙ্গে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার অপূর্ব সমন্বয় পরিলক্ষিত হয় । এখানে কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত বিষয়গুলির ওপর আইন প্রণয়ন করার অধিকারী হল কেন্দ্রীয় সরকার । রাজ্যতালিকাভুক্ত বিষয়গুলির ওপর আইন প্রণয়ন করেন রাজ্য সরকারসমূহ । যৌথ – তালিকাভুক্ত কোনাে বিষয়ে রাজ্য সরকার প্রণীত আইন কেন্দ্রীয় আইনের বিরােধী হলে রাজ্য সরকার প্রবর্তিত আইনটি বাতিল হয়ে যাবে এবং কেন্দ্রীয় আইনটিই বলবৎ থাকবে । কিন্তু জরুরি অবস্থায় বা প্রয়ােজনবােধে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা রাখেন । অনুল্লিখিত বিষয়গুলির ওপর আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতাও কেন্দ্রীয় সরকারের । সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের কাঠামােতে গঠিত হলেও ভারতের সংবিধান প্রয়ােজন অনুসারে এককেন্দ্রিক সংবিধানে পরিণতি হতে পারে বা তা অধিকমাত্রায় কেন্দ্ৰপ্রবণ।
(৪) ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সংবিধানের প্রাধান্য। ভারতীয় সংবিধান হল দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং সর্বপ্রকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও নাগরিক অধিকারের উৎস । সংবিধান দেশের আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং সর্বপ্রকার সরকারি প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বে। সংবিধান-বিরােধী কোনাে আইন প্রবর্তিত হলে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে সংবিধানের পবিত্রতা ও প্রাধান্য রক্ষা করে।
(৫) আয়ারল্যান্ডের সংবিধানের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানেরও কতকগুলি নির্দেশাত্মক নীতি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দেশের শাসন কর্তৃপক্ষ দেশশাসন করার সময় এই নীতিগুলির সঙ্গে যথেষ্ট সামঞ্জস্য রেখে চলার চেষ্টা করবেন। কিন্তু সরকার এগুলি না মানলে কোনাে নাগরিকই আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন না।
(৬) সংবিধানে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার ও মৌলিক কর্তব্য স্বীকৃত হয়েছে। এই মৌলিক অধিকারগুলির গুরুত্ব ভারতের নাগরিকদের কাছে অপরিসীম। এই সব মৌলিক অধিকারগুলির দ্বারা ভারতীয় নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার, সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি অধিকারসমূহ স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই সব অধিকার কোনাে রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার আইন প্রণয়ন করে ক্ষুন্ন করলে ভারতের যে কোনাে নাগরিক তা রক্ষার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। ১৯৭৬ সালের সংবিধানের ৪২ তম সংশােধনী আইনে নাগরিকগণের ১০ টি মৌলিক কর্তব্য সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সােভিয়েত রাশিয়ার সংবিধানেও এ ধরনের মৌলিক কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে।
(৭) যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের নীতি অনুযায়ী ভারতের সংবিধানে দ্বি – নাগরিকতার কোনাে ব্যবস্থা করা হয়নি। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে দ্বি – নাগরিকত্বের নীতি স্বীকৃত হলেও ভারতে এর ব্যবস্থা নেই। ভারতের নাগরিক বলতে সর্বভারতীয় নাগরিকত্বকেই বােঝায়। এখানে শুধুমাত্র এক – নাগরিকতা স্বীকৃত হয়েছে। ভারতীয় নাগরিকত্ব ব্যতীত ভারতীয়দের অন্য কোনাে প্রাদেশিক নাগরিকত্ব নেই।
(৮) ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার অবস্থিতি। বিচারক যাতে স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারেন, সেজন্য তাদের নিয়ােগকাল, কার্যকাল, বেতন, অন্যান্য সুযােগ-সুবিধা প্রভৃতি সম্পর্কে বিশেষ ব্যবস্থা আছে।
(৯) ভারতের সংবিধানে সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনাে দেশের সংবিধানে এই প্রকার ব্যবস্থা নেই।
(১০) ভারতের সংবিধান নমনীয় ও অনমনীয় সংবিধানের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের স্বাভাবিক নীতি অনুযায়ী এই সংবিধান অনমনীয় সংবিধান হওয়া উচিত ছিল , কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তা হয়নি। সংশােধনমূলক প্রস্তাব আনার সুযােগ থাকার জন্য তা নমনীয় হয়ে পড়েছে। আবার সাধারণ আইন প্রণয়ন পদ্ধতিতে এই সংবিধানের কোনাে কোনাে অংশ পরিবর্তন করা যায় না, সেইজন্য এই সংবিধান অনমনীয় সংবিধান।
আশা করি উপরের দশটি point এর মাধ্যমে আমরা ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য গুলি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছি। ভালো লাগল কমেন্ট এ জানাবেন।
Ha khob valo laglo
Thank you very much.
Pingback: মৌলিক কর্তব্য - Fundamental duties of Indian Citizen – Studious
dada amr exm a arokom akta questuon ashesilo ami nomoniyo o onmoniyo songbidane vishoye likesi tahole ki hbe duti boishisto lwkr jpinno bolechen aa doiti liksi tahole ki hbe right plz akkoni jnan
apni chinta koren na. Thik e achhe
Eta history r na political science ar??
bishoy bostu to eki hobe tai na seta history e hok r political science e hok
thank you
Good post