Skip to content

সাঁওতাল বিদ্রোহ | সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ | বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি | সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব

সাঁওতাল বিদ্রোহ কি, সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ

ইতিহাসের আগের পোস্ট গুলিতে আলোচনা করেছিলাম চুয়ার বিদ্রোহকোল বিদ্রোহ সম্পর্কে, আজ আমরা আলোচনা করবো সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে। জানবো সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ, সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র, সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব ইত্যাদি।

সাঁওতাল বিদ্রোহের বিবরণ ভূমিকা:

ভারতের প্রাচীন বাসিন্দা আদিবাসী সাঁওতালরা বর্তমান বিহারের ছোটোনাগপুর, পালামৌ, মানভূম এবং বাংলার বীরভূম, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ বনভূমি অঞ্চলে বসবাস করত। তারা ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইংরেজ সরকার, জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যা ‘হুল বিদ্রোহ’ বা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।

সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রসার : ক্ষুব্ধ সাঁওতালরা ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ইংরেজ কোম্পানি, দেশীয় জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, বীর সিং , কালো প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখ। ৩০ জুন প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে জড়ো হয়ে শোষণমুক্ত স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। বিদ্রোহীরা রেলস্টেশন, থানা, ডাকঘর প্রভৃতি আক্রমণ করে এবং বহু জমিদার ও মহাজনকে হত্যা করে।

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ

ভূমিকা : ছোটোনাগপুরের সাঁওতাল উপজাতি ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের সহযোগী জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন—

1) রাজস্ব আরোপ : আদিবাসী সাঁওতালরা অরণ্য অঞ্চলের পতিত জমি উদ্ধার করে চাষবাস করে সেই জমিকে উর্বর করে তোলে। ব্রিটিশ শাসনকালে সরকার-নিযুক্ত জমিদাররা সেই জমির ওপর উচ্চহারে রাজস্ব চাপালে সাঁওতাল কৃষকরা জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

2) অন্যান্য কর : ভূমিরাজস্ব ছাড়াও সরকার, জমিদার প্রমুখ সাঁওতালদের ওপর বিভিন্ন ধরনের করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। ফলে দরিদ্র সাঁওতালদের দুর্দশা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।

3) মহাজনদের শোষণ : সাঁওতালরা নগদে ভূমিরাজস্ব ও অন্যান্য কর পরিশোধে বাধ্য হয়ে মহাজনদের কাছ থেকে অত্যন্ত চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হত। পরবর্তীকালে ঋণের দায়ে তার জমি, ফসল, বলদ কেড়ে নেওয়া হত।

4) ব্যবসায়ীদের প্রতারণা : বহিরাগত ব্যবসায়ীরা কেনারাম নামক বাটখারা ব্যবহার করে সাঁওতালদের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কেনার সময় এবং বেচারাম নামক বাটখারা ব্যবহার করে নিজেদের পণ্যগুলি সাঁওতালদের কাছে বিক্রির সময় ঠকাত।

5) রেলপথ নির্মাণ : সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণের কাজে সাঁওতাল শ্রমিকদের নিয়োগ করে তাদের খুব কম মজুরি দেওয়া হত। তা ছাড়া রেলের ঠিকাদার ও ইংরেজ কর্মচারীরা সাঁওতাল পরিবারগুলির ওপর নানাভাবে অত্যাচার করত।

6) সাঁওতাল আইন বাতিল : সরকার সাঁওতালদের নিজস্ব আইন ও বিচারপদ্ধতি বাতিল করে সাঁওতাল এলাকায় ইংরেজদের জটিল আইন ও বিচারব্যবস্থা চালু করে।

7) খ্রিস্টধর্ম প্রচার : খ্রিস্টান মিশনারিরা সাঁওতালদের ধর্মকে অবজ্ঞা করত এবং সুকৌশলে সাঁওতালদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করত।

8) নীলচাষ : নীলকর সাহেবরা সাঁওতাল কৃষকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের নীলচাষ করতে হত। এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র

ভূমিকা : ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল দরিদ্র সাঁওতালদের আপসহীন এক সংগ্রাম। তবে এই বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র নিয়ে বিতর্ক আছে। যেমন—

  • আদিবাসী বিদ্রোহ : সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল বিহারের ছোটোনাগপুর অঞ্চলের আদিবাসী বা উপজাতি সাঁওতালদের বিদ্রোহ। আদিবাসী সাঁওতালরাই ছিল এই বিদ্রোহের প্রাণশক্তি
  • কৃষকবিদ্রোহ : সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল মূলত একটি কৃষকবিদ্রোহ। দরিদ্র ও শোষিত আদিবাসী সাঁওতাল কৃষকরা জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল
  • ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ : সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু জমিদার বা মহাজন – বিরোধী বিদ্রোহ ছিল না। এই বিদ্রোহ ছিল স্পষ্টতই ব্রিটিশ – বিরোধী। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর হ্যালিডে বলেন যে, ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোই এই বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল।
  • গণবিদ্রোহ : সাঁওতাল কৃষকদের উদ্যোগে এই বিদ্রোহ শুরু হলেও স্থানীয় কামার, কুমোর, তেলী, গোয়ালা, মুসলিম তাঁতি, চামার, ডোম প্রভৃতি সম্প্রদায় ও পেশার মানুষও এই বিদ্রোহে শামিল হয়। তাই নরহরি কবিরাজ একে সকল সম্প্রদায়ের দরিদ্র জনগণের মুক্তিযুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন
  • ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ : কেউ কেউ সাঁওতাল বিদ্রোহে ধর্মের প্রভাব দেখতে পেলেও এই বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে ধর্মকেন্দ্রিক ছিল না। বিদ্রোহী সাঁওতালরা ঈশ্বরকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি। বরং তারা চিৎকার করে বল—“ ঈশ্বর মহান , কিন্তু তিনি থাকেন বহু বহু দূরে। আমাদের বাঁচাবার কেউ নেই।

 

আরও পড়ুন:-

 

সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব

ভূমিকা : ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী বিদ্রোহগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ ( ১৮৫৫-৫৬ খ্রি.)। এই বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্বকে মোটেই অস্বীকার করা যায় না। যেমন—

  1. ব্যাপকতা : আদিবাসী সাঁওতালরা এই বিদ্রোহ শুরু করলেও এই ক্ষোভের আগুন নিম্নবর্ণের কামার , কুমোর, তাঁতি, ডোম, গোয়ালা প্রভৃতি হিন্দুদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
  2. সুদের হার হ্রাস : সাঁওতালদের বিদ্রোহের ফলে সরকার তাদের ওপর মহাজনি শোষণ সম্পর্কে সচেতন হয়। সরকার সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় বহিরাগত মহাজনদের ঋণের সুদের হার বেঁধে দেয়।
  3. সাঁওতাল পরগনা গঠন : সরকার সাঁওতালদের পৃথক ‘উপজাতি’ হিসেবে ঘোষণা করে ছোটোনাগপুর অঞ্চলে তাদের জন্য সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করে দেয়।
  4. সাঁওতালদের নিজস্ব আইন : সরকার ঘোষণা করে যে, সাঁওতাল পরগনায় ব্রিটিশ আইন কার্যকর হবে না। সেখানে সাঁওতালদের চিরাচরিত নিজস্ব আইন ও বিচারব্যবস্থা কার্যকরী হবে।
  5. বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ : সাঁওতালদের ওপর শোষণ – অত্যাচার লাঘব করার উদ্দেশ্যে সরকার সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় বাঙালি মহাজন – সহ বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে।
  6. খ্রিস্টধর্মের প্রসার : বহিরাগত দেশীয় মহাজনদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রবেশ ও সাঁওতালদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অবাধ সুযোগ দেওয়া হয়। সাঁওতালদের ‘ উন্নতি ’ ও ‘ মঙ্গল ’ সাধন করাই মিশনারিদের লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয়
  7. মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত : ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের মতে , এই বিদ্রোহ ছিল “ ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূতস্বরূপ। ” ড . রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন যে , ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করা হলে সাঁওতাল বিদ্রোহকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত।

Covered Topics;- সাঁওতাল বিদ্রোহ কি। সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ, সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র, সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব, সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল, সাঁওতাল বিদ্রোহের দুজন নেতার নাম, সাঁওতাল বিদ্রোহ pdf, সাঁওতাল বিদ্রোহের এলাকা, সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল,সাঁওতাল বিদ্রোহ কবে হয়েছিল, সাঁওতাল বিদ্রোহ টীকা। Image- forwardpress.in

 

Share this

Related Posts

Comment us

6 thoughts on “সাঁওতাল বিদ্রোহ | সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ | বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি | সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব”

  1. অসাধারণ আলোচনা,
    “হুল” শব্দের অর্থ “বিদ্রোহ” আর আপনি লিখেছেন “হুল বিদ্রোহ”- এই জায়গায় একটু ভুল দেখতে পাচ্ছি,
    “হুল বিদ্রোহ”= বিদ্রোহ বিদ্রোহ
    সাঁওতাল হুল= সাঁওতাল বিদ্রোহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Facebook Page