ভূপৃষ্ঠের মোট ক্ষেত্রফল এর প্রায় 71.4% জলভাগ 28.6% স্থলভাগ। এই স্থলভাগের ভৌগোলিক নাম হল বারিমন্ডল। মহাসাগর সাগর, নদ-নদী, খাল-বিল প্রভৃতির সমস্ত প্রকার জলভাগে বারিমন্ডলের অন্তর্গত। বারিমন্ডলের এর মধ্যে 90% মহাসাগর, সাগর, উপসাগর প্রভৃতি এবং বাকি অধিকার করে আছে নদী ও হ্রদ প্রভৃতি। বারিমন্ডলের বিভিন্ন আলোচনায় সমুদ্রস্রোত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।
সমুদ্রস্রোত কাকে বলে?
পৃথিবীর আবর্তন গতি, বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্র জলের লবনতা ঘনত্ব ও উষ্ণতার পার্থক্যের জন্য সমুদ্রের ওপরের জলরাশি নিয়মিতভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়। সমুদ্রজলের এই গতিকে সমুদ্রস্রোত বলে। উষ্ণতার তারতম্য অনুসারে সমুদ্রস্রোত কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। উষ্ণ স্রোত ও
শীতল স্রোত।
সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির প্রধান কারণ গুলি কি কি?
নানান কারণে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। উল্লেখযোগ্য কারণ গুলি হল-
1) নিয়ত বায়ুপ্রবাহ= নিয়ত বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির প্রধান কারণ। পশ্চিমা বায়ু, আয়ন বায়ু ও মেরু বায়ুর প্রভাব অনুযায়ী প্রধান প্রধান সমুদ্র স্রোত গুলির সৃষ্টি হয়।
2) পৃথিবীর আবর্তন গতি= পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে ফেরেলের সূত্রানুসারে সমুদ্রের জল উত্তর গোলার্ধের ডান দিকে বেঁকে যায়। দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিক বেঁকে যায় এর ফলে সমুদ্রস্রোত সৃষ্টি হয়।
3) সমুদ্র জলের লবনতা পার্থক্য= সমুদ্র জলের লবনতা পরিমাণ সর্বত্র সমান হয় না। অধিক লবণাক্ত জল বেশি ভারী বলে তার ঘনত্ব বেশি হয়। বেশি ঘনত্বের জল কম ঘনত্ব জলের দিকে প্রবাহিত হয় ও সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়।
4) সমুদ্রজলের উষ্ণতার পার্থক্য= উষ্ণমন্ডলের সমুদ্রজল বেশি উষ্ণ হয়। এই জলের উপরের অংশ দিয়ে পৃষ্ঠ প্রবাহ রূপে মেরু অঞ্চল বা শীতল অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। উষ্ণমন্ডলের এই ঘাটতি পূরণ করার জন্য মেরু অঞ্চল থেকে শীতল ও ভারী জল জলের নিচের অংশ দিয়ে আন্তঃপ্রবাহ বা অন্তস্রোত রূপে উষ্ণমন্ডল এর দিকে প্রবাহিত হয়। এইভাবে উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোত সৃষ্টি হয়।
5) স্থলভাগের অবস্থান= সমুদ্রস্রোতের প্রবাহ পথে কোনো মহাদেশ ও দ্বীপ থাকলে সমুদ্রস্রোত তাতে বাধা পায় ও গতিপথ পরিবর্তন করে। এর প্রভাবে সমুদ্রস্রোত একাধিক শাখায় বিভক্ত হয়।
অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরের সমুদ্রস্রোত
নিরক্ষীয় স্রোত [উষ্ণ]= অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরের নিরক্ষীয় অঞ্চলে পৃথিবীর আবর্তন গতি এবং উত্তর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর প্রভাবে দুটি উষ্ণ স্রোতের সৃষ্টি হয়।
- উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত= নিরক্ষরেখার উত্তর দিকে দিয়ে উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ুর প্রভাবে উষ্ণ স্রোত পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয় তাকে উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত বলে।
- দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত= নিরক্ষরেখার দক্ষিণ দিক দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর প্রভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের সৃষ্টি হয়।
দক্ষিণ অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরের সমুদ্রস্রোত
1) ব্রাজিল স্রোত [উষ্ণ]= দক্ষিণ নিরক্ষীয় সমুদ্রস্রোত দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের উপকূলের নিকটে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। দক্ষিণের শাখাটি ব্রাজিল উপকূল বরাবর ব্রাজিল সমুদ্রস্রোত রূপে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়। একসময় শীতল কুমেরু স্রোতের সঙ্গে মিশে যায়।
2) ফকল্যান্ড স্রোত [শীতল]= দক্ষিণ অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরের কুমেরু স্রোতের একটি শাখা দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব উপকূল বরাবর সামান্য উত্তরে অগ্রসর হয়ে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ এর নিকট এই সমুদ্র স্রোত ফকল্যান্ড স্রোত নামে পরিচিত।
3) বেঙ্গুয়েলা স্রোত [শীতল]= কুমেরু স্রোতের প্রধান শাখা পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আফ্রিকার দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলের বাধা পেয়ে উত্তরে বেঁকে যায় এবং বেঙ্গুয়েলার নিকট বেঙ্গুয়েলা সমুদ্রস্রোত রূপে প্রবাহিত হয়। আরও উত্তরে এই সমুদ্র স্রোত দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু প্রবাহে দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত এর সঙ্গে মিলিত হয়।
উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের স্রোত সমুদ্রস্রোত
1) ক্যারিবিয়ান স্রোত [উষ্ণ]= দক্ষিণ নিরক্ষীয় সমুদ্রস্রোতের উত্তরের শাখা নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে ক্যারিবিয়ান উপসাগরে উত্তর নিরক্ষীয় সমুদ্রস্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়ে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবাহিত শাখাটি ক্যারিবিয়ান স্রোত নামে পরিচিত।
2) বাহামা স্রোত [উষ্ণ]= ক্যারিবিয়ান উপসাগরের অপর শাখাটি পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এর উত্তরে বাহামা দ্বীপপুঞ্জের নিকট দিয়ে বাহামা স্রোত নামে প্রবাহিত হয়েছে।
3) উপসাগরীয় স্রোত [উষ্ণ]= ফ্লোরিডার স্রোত পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয় ও মেক্সিকো উপসাগরে উপসাগরীয় স্রোত নামে পরিচিত। এই সমুদ্রস্রোত উত্তর-পূর্ব দিকে তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়।
- ইয়ামিঙ্গার স্রোত= উপসাগরীয় স্রোতের উত্তর শাখা আইসল্যান্ডের দক্ষিনে ইয়ামিঙ্গার স্রোত নামে প্রবাহিত হয়ে গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিমের শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের মিলিত হয়।
- উত্তর অ্যাটল্যান্টিক স্রোত= মধ্যম শাখাটি উত্তর অ্যাটল্যান্টিক স্রোত নামে উত্তর-পূর্ব দিকে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের পশ্চিম উপকূল বরাবর অগ্রসর হয়। আরও উত্তরে এই স্রোত নরওয়ে স্রোত নামে পরিচিত।
- ক্যানারি স্রোত= দক্ষিণের শাখাটি পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয় আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিমে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ নিকট বাধা পেয়ে ক্যানারি স্রোত রূপে দক্ষিনে বেঁকে যায় এবং অবশেষে উত্তর নিরক্ষীয় সমুদ্রস্রোত এর সঙ্গে মিলিত হয়। এই স্রোতের একটি শাখা গিনি উপকূলে নিকট গিনি স্রোত রূপে প্রবাহিত হয়।
গ্রীনল্যান্ড স্রোত [শীতল]= সুমেরু মহাসাগর থেকে শীতল স্রোতের একটি শাখা গ্রীনল্যান্ডের পূর্ব উপকূল বরাবর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয় এর নাম গ্রীনল্যান্ড স্রোত।
ল্যাব্রাডর স্রোত [শীতল]= সুমেরু মহাসাগরের শীতল স্রোতের অপর একটি শাখা গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূল বরাবর প্রবাহিত হয়ে গ্রীনল্যান্ডের দক্ষিনে কানাডার উপদ্বীপের নিকট গ্রীনল্যান্ডের স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়। এই সমুদ্রস্রোত ল্যাব্রাডর স্রোত নামে পরিচিত। এই স্রোত আরও দক্ষিনে নিউফাউন্ডল্যান্ড এর নিকট নিউফাউন্ডল্যান্ড স্রোত নামে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়।
ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের নিকট অন্তঃস্রোত রূপে শীতল স্রোত প্রবাহিত হয়।
আরও পড়ুন:
- বায়ুপ্রবাহ (Wind) কি? | বায়ুপ্রবাহ কয় প্রকার ও কি কি?
- পৃথিবীর তাপবলয় কি? | চিত্রসহ পৃথিবীর তাপবলয়ের বিবরণ দাও
- জোয়ার ভাটা কি? কেন জোয়ার ভাটা হয় ?
অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরের সমুদ্রস্রোত সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন উত্তর
1) শৈবাল সাগর কি?
উত্তর অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরে উপসাগরীয় স্রোত, ক্যানারি স্রোত ও উত্তর নিরক্ষীয় সমুদ্রস্রোতের মিলনের ফলে এক বিরাট এলাকাজুড়ে জলাবর্ত বা ঘূর্ণিস্রোতের সৃষ্টি হয়। এই জলাবর্তের ভিতর স্থির জলে বিভিন্ন আগাছা শৈবাল ও জলজ উদ্ভিদ জন্মায়। এই অংশকে শৈবাল সাগর বা সারাগোসা সাগর বলে।
2) হিমপ্রাচীর কি?
নিউফাউন্ডল্যান্ডের নিকট শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত, উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের মিলিত অঞ্চলে, উষ্ণ স্রোতের ঘন নীল জল এবং শীতল স্রোতের ঘন সবুজ জলের সীমারেখা অনেক দূর পর্যন্ত স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এই সীমারেখাকে হিমপ্রাচীর বলে।
3) উপসাগরীয় স্রোত এর প্রভাব গুলি আলোচনা করো।
i) উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের অনুকূলে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলো বাণিজ্য সুবিধা হয়।
ii) উষ্ণ উত্তর অ্যাটল্যান্টিক স্রোতের প্রভাবে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের উপকূল শীতকালে বরফ মুক্ত থাকে।
4) ল্যাব্রাডর স্রোত ও উপসাগরীয় স্রোতের মিলন এর প্রভাব গুলি আলোচনা করো
i) শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা হিমশৈল জাহাজ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।
ii) ল্যাব্রাডর স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা হিমশৈলগুলির উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের প্রভাবে গলে যায়। হিমশৈলের মধ্যে জমাট বাঁধা নুড়ি, কাকর, পলি প্রভৃতি হিমশৈল গলে যাওয়ার ফলে সমুদ্র তলদেশে সঞ্চিত হয় এবং একসময় সেখানেও গভীর মগ্নচড়ার সৃষ্টি হয়। গ্র্যান্ড ব্যাংক, সেব্যল ব্যাংক, জর্জেস ব্যাংক প্রভৃতি এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে।
iii) শীতল ও উষ্ণ স্রোতের মিলনস্থলে বাণিজ্যিকভাবে মাছ আহরণ করা হয়।
iv) উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনের ফলে নিউফাউন্ডল্যান্ড উপকূলে ঘন কুয়াশা সৃষ্টি হয় এবং ঘূর্ণিঝড়ের ফলে প্রবল ঝড়ঝঞ্জা দেখা যায়।
হ্যালো বন্ধুরা পরবর্তী post এ আমরা আলোচনা করবো প্রশান্ত মহাসাগরের সমুদ্রস্রোত
Pingback: আবহবিকার কাকে বলে? যান্ত্রিক আবহবিকার ও রাসায়নিক আবহবিকার – Studious
Pingback: নদীর ক্ষয়কার্য কাকে বলে | নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরুপ – Studious