বন্ধুর আজ আমরা আলোচনা করবো পৃথিবীর বায়ুচাপ বলয়-এর সম্পর্কে। আমার এই post টির মাধ্যমে বায়ুচাপ বলয় বিষয় টি খুব সহজ সরলভাবে আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি। আশাকরি আপনাদের খুব ভালো লাগবে।
বায়ুমন্ডলের চাপ
বায়ুমন্ডলের চাপ, আবহাওয়া ও জলবায়ুর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বায়ুকে নিজের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে বলে অন্যান্য পদার্থের মত বায়ুর ওজন আছে। ওজন আছে বলে বায়ুর চাপ আছে।
বায়ুমন্ডলের চাপ বলতে কী বোঝো?
ভূপৃষ্ঠে কোন নির্দিষ্ট পরিমিত বর্গক্ষেত্রর উপরে বায়ুস্তরের যে ওজন বা চাপ পড়ে। তাকেই বায়ুমন্ডল চাপ বলে।
সমুদ্রপৃষ্ঠে বায়ুর স্বাভাবিক চাপ প্রতি বর্গ সেন্টিমিটার প্রায় 1kg ওজনের সমান। প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে 14.7 পাউন্ডের সমান। বায়ুর চাপ ইঞ্চির পরিবর্তে মিলিবার প্রকাশ করা হয়(মিলিবার হলো এমন বল বা শক্তি যা প্রতি বর্গ সেন্টিমিটার এ 1 গ্রাম চাপ দেয়)। সমুদ্রপৃষ্ঠে প্রায় 29.92 ইঞ্চি বায়ুর চাপ 1013.25 মিলবারের সমান। ব্যারোমিটার যন্ত্রের সাহায্যে বায়ুর চাপ পরিমাপ করা হয়।
**সমচাপ রেখা কি?
ভূপৃষ্ঠের যে সব স্থানে গড় বায়ুর চাপ কোন নির্দিষ্ট সময়ে সমান বা একই থাকে। মানচিত্রে সেইসব স্থানের উপর কোন কাল্পনিক রেখা টানা হলে যে রেখা পাওয়া যায় তাকে সমচাপ রেখা বলা হয়।
বায়ুচাপের তারতম্যের কারণ কি?
ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে উষ্ণতার মতই বায়ুর চাপের তারতম্য দেখা যায়। নানা কারণে ভূপৃষ্ঠের বায়ু চাপের তারতম্য ঘটে এদের বায়ুচাপের নিয়ন্ত্রক বলে। এগুলি হল–
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার তারতম্য : সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বায়ুর চাপ হ্রাস পায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রতি 300 মিটার উচ্চতায় বায়ুর চাপ 1 ইঞ্চি বা 34 মিলিবার হ্রাস পায়।
বায়ুর উষ্ণতার তারতম্য : বায়ু উষ্ন হলে তা হালকা ও প্রসারিত হয়। ফলে বায়ুর চাপ কম হয় এই কারণে উষ্ণ বায়ুর চাপ কম হয়। আবার বায়ু শীতল হলে সংকুচিত হয় ফলে বায়ুর চাপ বাড়ে। এই কারণে শীতল বায়ুর চাপ বেশি।
বায়ুতে জলীয় বাষ্পের তারতম্য : জলীয় বাষ্প, বিশুদ্ধ বায়ু অপেক্ষা হালকা। তাই জলীয় বাষ্পপূর্ণ আর্দ্র বায়ু শুষ্ক বায়ুর তুলনায় হালকা বলে এর চাপ কম হয়। অপরদিকে শুষ্ক বায়ু বলে এর চাপ বেশি হয় এই কারণে বর্ষাকালে বায়ুতে জলীয় বাষ্প বেশি থাকে বলে বায়ুর চাপ কম হয়।
পৃথিবীর আবর্তন গতি : পৃথিবীর আবর্তন গতির প্রভাবে নিরক্ষীয় অঞ্চল ও সুমেরু, কুমেরু অঞ্চলে থেকে বাতাস ক্রান্তীয় অঞ্চলের দিকে বিক্ষিপ্ত হয়। এর ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চল এবং সুমেরু, কুমেরু অঞ্চলে বায়ুর নিম্নচাপ এবং ক্রান্তীয় অঞ্চলে বায়ুর উচ্চচাপ সৃষ্টি হয়।
পৃথিবীর বায়ুচাপ বলয়
ভূপৃষ্ঠের এক একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বায়ুর উচ্চচাপ ও নিম্নচাপ অনেকটা বলয়ের মধ্যে মতো ঘিরে অবস্থান করে। এদের বায়ুচাপ বলয় বলে।
বায়ু চাপের তারতম্য অনুসারে ভূপৃষ্ঠকে সাতটি নির্দিষ্ট বায়ুচাপ বলয় ভাগ করা যায়। এগুলি হল—
1) নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়।
2) কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয়।
3) মকরীয় উচ্চচাপ বলয়।
4) সুমেরুবৃত্ত নিম্নচাপ বলয়।
5) কুমেরুবৃত্ত নিম্নচাপ বলয়।
6) সুমেরু উচ্চচাপ বলয়।
7) কুমেরু উচ্চচাপ বলয়।
নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় কাকে বলে?
নিরক্ষরেখার উভয় পাশে 5°-10° অক্ষরেখার মধ্যে সারা বছর ধরে বায়ুর নিম্নচাপ দেখা যায়। একে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় বলে।
নিম্নচাপ সৃষ্টির কারণ :
1) এই অঞ্চলে সূর্য সারাবছর লম্বভাবে কিরণ দেয় বলে বায়ু খুব উষ্ণ হালকা হয়। ফলে বায়ুর চাপ কম হয়।
2) নিরক্ষীয় অঞ্চলে স্থলভাগের তুলনায় জলভাগ বেশি বলে বায়ুতে প্রচুর জলীয়বাষ্প থাকে। ফলে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু চাপ কম হয়। 3) পৃথিবীর আবর্তন গতির প্রভাবে এ অঞ্চলে ওপরের বায়ু উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ছিটকে যায় ফলে বায়ু চাপ কম হয়।
নিরক্ষীয় শান্তবলয় বা ডোলড্রাম কি?**
নিরক্ষীয় অঞ্চলে উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু মিলিত হয় বলেই এই অঞ্চলে বায়ু বিক্ষিপ্ত হয়। একে আন্তঃক্রান্তীয় মিলন অঞ্চল বা ITCZ বলে। নিরক্ষরেখা বরাবর ITCZ একটানা বিস্তৃত নয়, স্থানে স্থানে বিচ্ছিন্ন। এই অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে বায়ুপ্রবাহ বোঝা যায় না, একপ্রকার শান্তভাব বজায় থাকে। একে নিরক্ষীয় শান্তবলয় বা ডোলড্রাম বলে।
কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় কাকে বলে?
কর্কটক্রান্তি রেখা ও মকরক্রান্তি রেখার উভয় পাশে 25°-35° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষরেখার মধ্যে সারাবছর ধরে বায়ুর উচ্চচাপ দেখা যায়। একে কর্কটীয় ও মকরীয় উচ্চচাপ বলয় বলে।
উচ্চচাপ সৃষ্টির কারণ :
1) নিরক্ষীয় নিম্নচাপ অঞ্চলের উষ্ণ বায়ু উপরে উঠে শীতল হয় এবং পৃথিবীর আবর্তন গতির প্রভাবে তা উত্তর-দক্ষিণে ছিটকে গিয়ে ক্রমশ সংকুচিত হয় এবং ক্রান্তীয় অঞ্চলে নিচের দিকে নেমে আসে।
2) সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলের শীতল বাতাস পৃথিবীর আবর্তনের ফলে ক্রান্তীয় অঞ্চলে নেমে আসে ফলে বায়ু চাপ বেশি হয়।
**কর্কটক্রান্তি রেখার নিকটবর্তী অঞ্চলে উচ্চচাপ বলয়কে কর্কটীয় উচ্চচাপ বলয় এবং মকরক্রান্তি রেখার নিকটবর্তী উচ্চচাপ বলয়কে মকরীয় উচ্চচাপ বলয় বলে।
কর্কটীয় ও মকরীয় শান্ত বলয় কাকে বলে?**
এই অঞ্চলের শীতল বাতাস উপর থেকে নিচে নেমে আসে বলে, ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে বায়ুপ্রবাহ বিশেষ দেখা যায় না। একপ্রকার শান্ত ভাব বজায় থাকে একে কর্কটীয় ও মকরীয় শান্তবলয় বলে।
অশ্ব অক্ষাংশ কাকে বলে?**
উত্তর গোলার্ধে কর্কটীয় শান্তবলয় অঞ্চলে 25°-35° উত্তর অক্ষরেখার মধ্যে সাধারণত আটলান্টিক মহাসাগরে বায়ুর কোন রূপ প্বার্শপ্রবাহ দেখা যায় না বলে এই অঞ্চলকে অশ্ব অক্ষাংশ বলা হয়।
অশ্ব অক্ষাংশ বলা হয় কেন?**
পূর্বে যখন পালতোলা জাহাজ এর সাহায্যে বাণিজ্য করা হতো। তখন একবার ইউরোপীয় ভূখণ্ড হতে ঘোড়া বোঝায় পালতোলা জাহাজ আটলান্টিক মহাসাগরে কর্কটীয় শান্তবলয় এ বায়ুপ্রবাহ না থাকায় আটকে পড়ে। জাহাজকে হালকা করার জন্য এবং পানীয় জল ও খাদ্য বাঁচানোর জন্য তখন বহু ঘোড়াকে জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তাই 25°-35° উত্তর অক্ষাংশকে অশ্ব অক্ষাংশ বলা হয়।
ক্রান্তীয় অঞ্চলে পৃথিবীর অধিকাংশ উষ্ণ মরুভূমি সৃষ্টি হয়েছে কেন?**
ক্রান্তীয় অঞ্চলে সব সময় বায়ু উপর থেকে নিচে নামে, ফলে এর উষ্ণতা ও জলীয়বাষ্প গ্রহণ করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। তাই ক্রান্তীয় অঞ্চলের নিম্নমুখী বায়ুর প্রভাবে তেমন বৃষ্টিপাত হয় না। এইজন্য ক্রান্তীয় অঞ্চলে পৃথিবীর অধিকাংশ উষ্ণ মরুভূমি সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- সাহারা, কালাহারি প্রভৃতি।
সুমেরু ও কুমেরু বৃত্ত নিম্নচাপ বলয় কাকে বলে?
উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে 60°- 70° ডিগ্রি অক্ষরেখার মধ্যে সুমেরু ও কুমেরু বৃত্তের দুপাশে সারাবছরই বায়ুর নিম্নচাপ দেখা যায়। একে সুমেরু ও কুমেরু বৃত্তের নিম্নচাপ বলয় বলে।
নিম্নচাপ সৃষ্টির কারণ :
1) এই অঞ্চলে পৃথিবীর আবর্তনের বেগ তুলনামূলকভাবে বেশি বলে, এই অঞ্চলের বায়ু ক্রান্তীয় ও মেরু অঞ্চলের দিকে ছিটকে যায় ফলে বায়ুর চাপ কম হয়।
এই অঞ্চলে ও পশ্চিমা ও মেরু বায়ু প্রবাহের মিলিত অঞ্চলে সুমেরু ও কুমেরু বৃত্তের শান্ত বলয় সৃষ্টি হয়েছে।
সুমেরু ও কুমেরু উচ্চচাপ বলয় কাকে বলে?
সুমেরু ও কুমেরু বিন্দু এবং সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলে 70°- 90° অক্ষরেখার মধ্যে সারা বছরই বায়ুর উচ্চচাপ দেখা যায়। একে সুমেরু ও কুমেরু উচ্চচাপ বলয় বলে।
উচ্চ চাপ সৃষ্টির কারণ :
1) এক অঞ্চলের সূর্যরশ্মি সারা বছরই খুব তীর্যকভাবে পড়ে বলে বাতাস খুব শীতল ও ভারী হয় ফলে বায়ুর চাপ বেশি হয়।
2) প্রচন্ড ঠান্ডার জন্য এই অঞ্চলের বায়ুতে জলীয় বাষ্প খুব কম থাকে বলে বায়ুর চাপ বেশি হয়।
3) সুমেরু ও কুমেরু বৃত্ত নিম্নচাপ বলয় থেকে মেরুর দিকে যে বাতাস ছিটকে যায়। তা এই অঞ্চলের নিচে নেমে আসে ফলে বায়ুর চাপ বেশি হয়।
বায়ুচাপ বলয়ের সীমানা পরিবর্তনের কারণ গুলি কি কি?
1) সূর্যের বার্ষিক আপাত গতি।
2) সূর্য রশ্মির পতনকোণ এর পার্থক্য।
3) ভূমির উচ্চতা।
4) স্থলভাগ ও জলভাগ এর অবস্থান।
5) পৃথিবীর আবর্তন গতির , প্রভৃতি কারণে প্রভাবে ভূপৃষ্ঠের তাপ ও চাপ বলয় গুলি অবস্থানের সামান্য পরিবর্তন ঘটে। সূর্যের উত্তরায়ন ও দক্ষিনায়ন এর সঙ্গে সঙ্গে ভূপৃষ্ঠের তাপ ও চাপ বলয় গুলি কিছুটা স্থান পরিবর্তন করে।
বায়ুচাপ বলয়ের সীমানা পরিবর্তনের প্রভাব :
1) সূর্যের উত্তরায়ন এর সময় নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয় 5°-10° উত্তরে সরে যাওয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু রূপে প্রবাহিত হয়।
2) 30°-40° অক্ষরেখা মধ্যবর্তী বায়ুচাপ বলয় গুলির গ্রীষ্মকালে উত্তরে সামান্য সরে যাওয়ায় এই অঞ্চলের শুষ্ক আয়ন বায়ুর প্রভাব দেখা যায়। আবার শীতকালে এই অঞ্চলে দক্ষিণের সামান্য সরে যাওয়ায় আদ্র পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে আসে। এইজন্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে শীতকালে বৃষ্টিপাত হয়, গ্রীষ্মকালে তেমন হয় না
Pingback: ভঙ্গিল পর্বত কাকে বলে, বৈশিষ্ট্য ও ভঙ্গিল পর্বত সৃষ্টির কারণ – Studious
Pingback: বায়ুচাপের তারতম্যের কারণ | বায়ুচাপ বলতে কি বোঝ – Studious
It is very good 👍