ভূগোলের আগের অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি নদীর ক্ষয় কার্য সম্পর্কে, আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় নদীর সঞ্চয় কার্য। আজ এই পোস্ট এ আমরা আলোচনা করবো নদীর সঞ্চয় কার্য কাকে বলে? নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ, নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে কি কি ভূমিরূপ সৃষ্টি হয় ইত্যাদি।
নদীর সঞ্চয় কার্য কাকে বলে?
নদী কী সঞ্চয় করে?
নদীবাহিত বিভিন্ন নুড়ি, কাকর, বালি পলি প্রভৃতি নদীর তলদেশে, নদীর দুপাড়ে এবং মােহনার নিকট সঞ্চিত হয়।
নদীর সঞ্চয়কার্য করে কেন ?
- প্রধানত চারটি কারণে নদী সঞয়কাজ করে।
- ঐ নদীতে প্রবাহিত জলের পরিমাণ কমে গেলে,
- ভূমির ঢাল হ্রাস পেলে,
- নদীতে বাহিত শিলাখণ্ডের পরিমাণ বেড়ে গেলে এবং
- নদীর বহন ক্ষমতা কমে গেলে নদী সঞ্চয় করে
নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
নদী প্রবাহের সমস্ত অংশেই নদীর সঞ্চয় কার্য কম-বেশি লক্ষ করা যায়। তবে সমভূমি অঞ্চলে মধ্যগতি ও নিম্নগতিতে নদীর সঞ্চয় কার্য সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। সঞ্চয় কার্য ফলে নানা ধরনের ভূমিরূপ গঠিত হয়। নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ গুলি হল—
❶ বদ্বীপ Delta) : নদীর মােহনার নিকট নদীর স্রোতের বেগ খুবই কম থাকে। এই স্থানে নদীর সঙ্গে বয়ে আসা সূক্ষ্ম পলি , বালি কাদা প্রভৃতি সমুদ্র বা হ্রদের লবণাক্ত জলের সংস্পর্শে এসে দ্রুত থিতিয়ে পড়ে। ফলে মােহনা ক্রমশ অগভীর হয়। দীর্ঘদিন ধরে এইভাবে পলি সঞ্জয়ের ফলে সমুদ্র বা হ্রদের বুকে নতুন দ্বীপের (যেমন—সাগর দ্বীপ) সৃষ্টি হয়।
এরূপ দ্বীপ দেখতে অনেকটা মাত্রাহীন ‘ব’ বা গ্রিক অক্ষর A (ডেল্টা) -র মতাে হয় বলে একে বদ্বীপ বলে।
দ্বীপের নিকট নদী বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়। বিভিন্ন বদ্বীপগুলির চারপাশে ক্রমশ পলি জমা হয়ে বদ্বীপগুলি জুড়ে বিস্তীর্ণ সমভূমির সৃষ্টি করে। একে বদ্বীপ সমভূমি বলে।
গঙ্গা ও ব্রম্মপুত্র নদের মিলিত বদ্বীপ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ এবং সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ সমভূমি। মাত্রাহীন ‘ ব’অক্ষর বা গ্রিক অক্ষর A ( ডেল্টা ) -র মতাে বদ্বীপ দেখা যায় গঙ্গ , নীল , পপা প্রভৃতি নদ – নদীতে। পাখির পা বা আঙুলের মতাে বদ্বীপ দেখা যায় মিসিসিপি নদীতে। করাতের দাঁতের মতাে বদ্বীপ দেখা যায় ইতালির তাইবার নদীতে।
❸ পলিশঙ্কু ও পললপাখা (Alluvial Cone and Alluvial Fan) : পর্বতের পাদদেশ অঞ্চলে বা পার্বত্য অঞ্চলে কোনাে ছােটো নদী অন্য নদীতে মিলিত হওয়ার সময় ঢাল হঠাৎ কমে গেলে নদীবাহিত বিভিন্ন ক্ষয়জাত পদার্থ পাদদেশ অঞ্চলে সঞ্চিত হয়। পলিরাশি শঙ্কুর আকারে সঞ্চিত হলে তাকে পলিশঙ্কু এবং পাখার আকারে সঞ্চিত হলে তাকে পললপাখা বলে।
❹ অগভীর ও চওড়া নদী উপত্যকা (Shallow river valley) : সমভূমি অঞ্চলে নদীপথের ঢাল কমে যায় বলে অধিক পার্শ্বক্ষয়ের জন্য নদী ক্রমশ অগভীর হয় ও চওড়া নদী উপত্যকার সৃষ্টি করে।
❺ প্লাবন ভূমি (Flood plain) : সমভূমি অঞ্চলে মধ্য ও নিম্নগতিতে নদীগর্ভে বিভিন্ন পদার্থের সঞ্চয়ের ফলে নদীখাত অগভীর হয়ে পড়ে। ফলে বর্ষাকালের অতিরিক্ত জলরাশি অগভীর নদীখাতে প্রবাহিত হতে না পেরে বন্যার সৃষ্টি করে। বন্যার জলের সঙ্গে বয়ে আনা সূক্ষ্ম পলি, বালি, কাদা প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে এক নতুন ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। একে প্লাবনভূমি বলে। পৃথিবীর অধিকাংশ বড়াে নদীই এইভাবে তাদের মধ্য ও নিম্নগতিতে প্লাবনভূমির সৃষ্টি করেছে।
❼ স্বাভাবিক বাঁধ (Natural Levee): প্লাবনভূমি সৃষ্টির সময় অনেক ক্ষেত্রে নদীর দুপাড় বরাবর পলি, বালি, কাদা প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে উঁচু বাঁধের সৃষ্টি করে। এরূপ বাঁধকে স্বাভাবিক বাঁধ বা লিভি বলে। বন্যার সময় অনেকক্ষেত্রে স্বাভাবিক বাঁধ ভেঙে যায়। একে প্লাবন ফাটল বলে।
❽ নদী বাঁক (Meander) : সমভূমি অঞ্চলে নদীর শক্তি কমে যায় বলে নদীর গতিপথে কঠিন শিলাস্তর অবস্থান করলে বাধা এড়ানাের জন্য নদী আঁকাবাঁকা গতিপথে প্রবাহিত হয়। নদীর এরূপ আঁকাবাঁকা প্রবাহকে নদীবাঁক বলে। নদীবাঁকের জলস্রোতের আঘাত যুক্ত স্থানে (অবতল পাড়) ক্ষয় বেশি হয় এবং জলস্রোতের স্বল্প আঘাত যুক্ত স্থানে (উত্তল পাড়) সঞ্চয় বেশি হয়। এর ফলে নদী আরও বাঁকযুক্ত হয়ে পড়ে। যে পাড়ে ক্ষয় বেশি হয় সেখানে গভীর খাতের সৃষ্টি হয় [পুল Pool )]। বাঁকের বাহু দুটিতে পলি সঞ্জয়ের ফলে জলের
❾ অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ (Horse shoe lake) : অসংখ্য বাকবিশিষ্ট নদীতে পার্শ্বক্ষয়ের ফলে নদীর বাঁক এত বেশি বৃদ্ধি পায় যে অনেক সময় দুটি বাঁক খুব কাছাকাছি এসে পড়ে। এরূপ ক্ষেত্রে ওই বাঁক দুটির মধ্যবর্তী অংশ বাঁক ক্ষয় পেলে বাঁক দুটি জুড়ে যায় ও নদী সােজা পথে বয়ে চলে। ক্ষয়প্রাপ্ত বাঁকা অংশটি তখন নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হ্রদের আকার ধারণ করে। এরূপ হ্রদ অনেকটা ঘােড়ার ক্ষুরের মতাে দেখতে হয় বলে একে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বলে।
মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাগীরথী নদীর দুপাশে এরূপ বহু অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়।
❿ বালুচর (Sand bank) : মধ্য ও নিম্নগতিতে নদীবাহিত বিভিন্ন শিলাখণ্ড, কাকর, নুড়ি, বালি, পলি প্রভৃতি নদীর তলদেশে ও নদীর দুপাড়ে সঞ্চিত হয় । ক্রমান্বয়ে পলি সঞ্জয়ের ফলে একসময় নদীর মাঝবরাবর ও নদীর পাড় বরাবর পলি, বালি প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে বালুচরের সৃষ্টি হয়। ভাগীরথী নদী নদীয়ার বিভিন্ন স্থানে এবং হুগলি নদী হালিশহরের নিকট এরূপ বহু চর গঠন করেছে।
Covered Topics: নদীর সঞ্চয় কাকে বলে?, নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ, নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে কি কি ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়? নদীর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট তিনটি ভূমিরূপের বর্ণনা দাও, বদ্বীপ কাকে বলে?, বদ্বীপ কিভাবে সৃষ্টি হয়?, প্লাবন ভূমি কাকে বলে?, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ কাকে বলে?, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ কিভাবে সৃষ্টি হয়? ইত্যাদি।
feature image credit: thoughtco.com
Pingback: হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ চিত্রসহ | হিমবাহের ক্ষয়কার্য – Studious
অনেক কিছু শিখতে পারলাম। আপনার লেখা গুলো খুব দারুন। খুব স্পষ্ট বোঝা যায়। ধন্যবাদ sir