হ্যালো বন্ধুরা, আজ আমাদের বিষয় “শব্দবিজ্ঞান”। পদার্থবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষাই এই শব্দবিজ্ঞান অধ্যায় থেকে কম বেশি প্রশ্ন অশেয় থাকে। সুতরাং বন্ধুরা শুরু করা যাক
শব্দবিজ্ঞান কি?
বিজ্ঞানের যে শাখায় শব্দ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে শব্দবিজ্ঞান বলে।
শব্দ কি?
কম্পনশীল বস্তু থেকে যে শক্তি জড় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে আমাদের কানে পৌঁছে মস্তিষ্কে এক বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করে। তাকে শব্দ বলা হয়।
শব্দের উৎস কি?
যেকোনো কম্পনশীল বস্তু শব্দের উৎস বা স্বনক। স্বনকের কম্পনের ফলে উৎপন্ন যান্ত্রিক শক্তি শব্দ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
শব্দের বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি?
1) শব্দ এক প্রকার শক্তি।
2) কম্পনশীল বস্তু থেকে শব্দ সৃষ্টি হয়।
3) শব্দ স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের মধ্য দিয়ে তরঙ্গের আকারে বিস্তার লাভ করে।
শব্দের শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী শব্দকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয় এগুলি হল-
শ্রুতিগোচর শব্দ: শব্দ উৎসের কম্পাঙ্ক 20Hz থেকে 20000 Hz এর মধ্যে থাকলে সেই শব্দ শুনতে পায়। একে শ্রুতিগোচর শব্দ বলে।
শব্দেত্তর শব্দ: শব্দ উৎসের কম্পাঙ্ক 20Hz অপেক্ষা কম হলে। তাদের শব্দেত্তর শব্দ বলা হয়। এই শব্দ আমরা শুনতে পাই না।
শব্দোত্তর শব্দ: শব্দ উৎসের কম্পাঙ্ক 20000Hz এর বেশি হলে তাকে শব্দোত্তর শব্দ বলা হয়।
শব্দের তরঙ্গ ধর্ম সংক্রান্ত কয়েকটি সংজ্ঞা
শব্দের তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য :
শব্দ একটি স্থিতিস্থাপক অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ। কারণ-
1) তরঙ্গ সৃষ্টির জন্য যেমন কম্পনের প্রয়োজন তেমনি শব্দ সৃষ্টির জন্য কম্পনের প্রয়োজন।
2) তরঙ্গের বেগ আছে শব্দেরও বেগ আছে।
3) তরঙ্গের মতো শব্দ বিস্তারের সময় মাধ্যমে স্থানচ্যুতি ঘটেনা।
4) তরঙ্গের মতো শব্দের প্রতিফলন, প্রতিসরণ ও ব্যতিচার হয়।
শব্দেরতরঙ্গ সংক্রান্ত কয়েকটি সংজ্ঞা
পর্যাবৃত্ত গতি বলতে কি বুঝি?: কোন গতিশীল বস্তু কনা একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর একই পথ বরাবর অতিক্রম করলে ঐ বস্তুর গতিকে পর্যাবৃত্ত গতি বলা হয়। যেমন সরল দোলকের গতি, সূর্যের চারপাশে গ্রহের গতি ইত্যাদি।
সরল দোলগতি কাকে বলে?: কোন বস্তুর ওপর কোনো বল যদি এমন ভাবে ক্রিয়া করে যাতে ওই বল বস্তুর গতিপথ এর মধ্যবিন্দু অভিমুখী হয় এবং ওই বিন্দু থেকে বস্তুর সরনের সমানুপাতিক হয়। তবে ওই বলের অধীনে বস্তুর গতি সরল দোলগতি বলা হয়। যেমন 4° এর কম কৌণিক বিস্তারে সরল দোলকের গতি।
পূর্ণ কম্পন কি?: কম্পনশীল বস্তু কনা একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে নির্দিষ্ট দিকে যাত্রা শুরু করে আবার একই দিক থেকে সেই বিন্দুতে ফিরে এলে তাকে একটি পূর্ণ কম্পাঙ্ক বলা হয়।
পর্যায়কাল: কম্পনশীল বস্তুকণাটির একটি পূর্ণ কম্পনের জন্য যে সময় লাগে তাকে পর্যায়কাল(T) বলা হয়।
কম্পাঙ্ক: কোন কম্পনশীল কনা 1 সেকেন্ডে যতগুলি পূর্ণ কম্পন সম্পন্ন করে। সেই সংখ্যাকে ওই কনার কম্পাঙ্ক বলা হয়। কম্পাঙ্কের একক হার্জ বা সাইকেলস প্রতি সেকেন্ড এবং মাত্রা হয় T-1
তরঙ্গদৈর্ঘ্য(wavelength): স্বনকের একটি পূর্ণ কম্পনের জন্য কোন তরঙ্গের যতটা সরল রৈখিক স্থানচ্যুতি ঘটে। তাকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলা হয়। এক পর্যায়কাল সময়ে তরঙ্গ যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকেও তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে।
তির্যক তরঙ্গের ক্ষেত্রে পরপর দুটি তরঙ্গ শীর্ষ বা পরপর দুটি তরঙ্গপাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব এবং অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের ক্ষেত্রে একটি ঘনীভবন ও একটি অণুভবনের মোট দৈর্ঘ্যকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে। এর একক সেন্টিমিটার বা মিটার।
বিস্তার(Amplitude): স্থির অবস্থান থেকে কোন কম্পনশীল কণা উভয় দিকের সর্বাধিক যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে বিস্তার বলা হয়।
বেগ(Velocity): একক সময়ে কোন নির্দিষ্ট দিকে তরঙ্গ যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে ওই তরঙ্গের বেগ বলা হয়।
শব্দের বেগ সংক্রান্ত তথ্য সমূহ
আলোকতরঙ্গের মতো শব্দ তরঙ্গেরও বেগ আছে; তবে আলোর বেগের তুলনায় শব্দের বেগের মান অনেক কম হয়। শব্দের বেগ কঠিন মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি এবং গ্যাসীয় মাধ্যমে সবচেয়ে কম।
শব্দের বেগ কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভর করে?
চাপের প্রভাব: তাপমাত্রা স্থির থাকলে শব্দের বেগ গ্যাসীয় মাধ্যমে চাপের উপর নির্ভর করে না।
ঘনত্বের প্রভাব: শব্দের বেগ গ্যাসীয় মাধ্যমে ঘনত্বের বর্গমূলের ব্যস্তানুপাতিক অতএব হালকা গ্যাসের শব্দের বেগ, ভারী গ্যাসের শব্দের বেগ অপেক্ষা বেশি।
তাপমাত্রার প্রভাব: গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বেগ মাধ্যমের পরম উষ্ণতার বর্গমূলের সমানুপাতিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে শব্দের বেগ বৃদ্ধি পায়।
আর্দ্রতার প্রভাব: বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ যত বাড়ে ততই তার ঘনত্ব কমে। যেহেতু শব্দের বেগ মাধ্যমের ঘনত্বের বর্গমূলের ব্যস্তানুপাতিক তাই বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বা আর্দ্রতা বৃদ্ধি পেলে শব্দের বেগ বৃদ্ধি পায়।
শব্দের বেগ সংক্রান্ত কয়েকটি ঘটনা এবং তার কারণ ও ব্যাখ্যা
1) ঠান্ডা ও শুষ্ক দিনে বায়ুতে শব্দের বেগ বর্ষার দিনে বায়ুতে শব্দের বেগ অপেক্ষা কম।
কারণ ও ব্যাখ্যা: তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও মাধ্যমের ঘনত্বের হ্রাস এর যুগ্ম প্রভাব।
2) দূরের সাইরেনের শব্দ শুনে ঘড়ি মেলায় ঘড়ি সঠিক সময় দেয় না।
কারণ ও ব্যাখ্যা: সাইরেন ও ব্যাক্তির মধ্যে দূরত্ব বেশি হওয়ায় সাইরেনের শব্দ ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগে। ফলে ওই শব্দ শুনে ঘড়ি মেলালে ঘড়ি সঠিক সময় নির্দেশ করে না।
3) রেললাইনের উপর হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হলো কোন ব্যক্তি কিছুদূরে লাইনের ওপর কান পেতে থাকলে দুটি শব্দ শুনবেন।
কারণ ও ব্যাখ্যা: শব্দের বেগ বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন কঠিন মাধ্যমে শব্দের বেগ গ্যাস মাধ্যমের তুলনায় বেশি
শব্দের প্রতিধ্বনি কি?
প্রতিফলনের ফলে কোন শব্দ যদি মূলধ্বনি থেকে পৃথক ভাবে শ্রোতার কানে ওই শব্দের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। তখন ওই শব্দের প্রতিধ্বনি বলা হয়।
প্রতিধ্বনির ব্যবহার প্রয়োগ ঘটিয়ে সমুদ্রের গভীরতা ভূমি থেকে বিমানের উচ্চতা ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়।
ক্ষণস্থায়ী শব্দের প্রতিধ্বনি: কোন ক্ষণস্থায়ী শব্দের রেস মানব মস্তিষ্কে এক দশমাংশ(1/10) সেকেন্ড স্থায়ী হয়। একে শব্দ নির্বন্ধ বলা হয়। ক্ষণস্থায়ী শব্দের প্রতিধ্বনি শুনতে শ্রোতার থেকে প্রতিফলকের নূন্যতম দূরত্ব হতে হবে 17 মিটার প্রায়।
শব্দের প্রতিফলন বলতে কী বোঝায়?
আলোর মতো শব্দের প্রতিফলন হয়। কিন্তু যেহেতু শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত বেশি। তাই শব্দের প্রতিফলনের জন্য বিস্তৃত প্রতিফলকের প্রয়োজন। এছাড়া প্রতিফলকের মসৃণতার ওপর প্রতিফলন নির্ভর করে না
শব্দের প্রতিফলনের ব্যবহারিক প্রয়োগ:
1) আগেকার দিনে বড় মোটর গাড়িতে এবং বড় বাড়িতে কথাবার্তা বলার জন্য একপ্রকার নল ব্যবহার করা হতো একে স্পিকিং টিউব বা কথা বলার নল বলা হয়।
2) ডাক্তারেরা রোগীর হৃদস্পন্দনের শব্দ পরীক্ষার জন্য স্টেথোস্কোপ নামে যে যন্ত্র ব্যবহার করেন তার কার্যপ্রণালী স্পিকিং টিউবের মতো শব্দের প্রতিফলনের উপর প্রতিষ্ঠিত।
3) দূর থেকে আসা ক্ষীন শব্দ শোনার জন্য আমরা হাতের তালুতে কানের কাছে বাকিয়ে ধরি। হাতের তালু অবতল প্রতিফলকের কাজ করে এবং শব্দকে প্রতিফলিত করে কানে পৌঁছে দেয়।
4) বড় বড় হলঘরে বক্তৃতা দেওয়ার সময় হল ঘরের ছাদ সমতল না করে অবতল প্রতিফলকের আকার দিলে ছাদের বিভিন্ন স্থান থেকে শব্দ প্রতিফলিত হয়ে শ্রোতাদের কানে পৌঁছায়।
শব্দ সংক্রান্ত কয়েকটি ঘটনা এবং তার কারণ ও ব্যাখ্যা
1) বাদুড় অন্ধকারে দেখতে পায় না তার সত্বেও তাদের পথের আসা বিভিন্ন বাধা কে পাশ কাটিয়ে উঠতে পারে
কারণ ও ব্যাখ্যা: বাদুর মুখের শব্দোত্তর তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এর প্রতিফলনের শব্দ কানে শুনে বাধার অবস্থান আন্দাজ করে বাদুর উড়ে বেড়ায়।
2) সীতার, গিটার, বেহালা প্রভৃতিতে ফাঁপা কাঠের বাক্স থাকে কেন?
শব্দের উৎস এর কাছে অনুনাদি বস্তু থাকলে শব্দের প্রাবল্য বৃদ্ধি পায়।
3) দিনের বেলায় নদীর তীরে দাঁড়িয়ে জোরে চিৎকার করলেও দূরবর্তী নৌকা থেকে তার সহজে শোনা যায় না। কিন্তু রাত্রিবেলায় অনেক দূর থেকে সেই শব্দ শোনা যায়।
কারণ ও ব্যাখ্যা: উষ্ণতার পরিবর্তনে বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরের ঘনত্ব পরিবর্তিত হয়। ফলে দিনের বেলায় দূরাগত শব্দের বেশিরভাগ অংশ প্রতিসরণের ফলে উপর দিকে উঠে যায়। কিন্তু রাত্রিবেলায় অভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন এর জন্য স্পষ্টভাবে শোনা যায়।
শব্দের ডপলার ক্রিয়া বলতে কী বোঝো?
শব্দ উৎসের সঙ্গে যদি পর্যবেক্ষক বা শ্রোতার আপেক্ষিক গতি থাকে তবে পর্যবেক্ষকের কানে শব্দ উৎসের কম্পাঙ্ক প্রকৃত কম্পাঙ্ক থেকে আলাদা হয় এবং কম্পাঙ্কের এই আপাত পরিবর্তনকে আপাত পরিবর্তনকে শব্দের ডপলার ক্রিয়া বলা হয়।
উদাহরণ: কোন ট্রেন হুইসেল দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে এলে ওই প্লাটফর্মে দাঁড়ানো কোন পর্যবেক্ষকের কাছে হুইসেলের আপাত কম্পাঙ্ক ও শব্দের তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি পায়।
শব্দ সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
শব্দ বিস্তারের সময় বাস্তব মাধ্যমের প্রয়োজন শব্দ শূন্য মাধ্যমের মধ্য দিয়ে যেতে পারে না।
দুটি মাধ্যমের ঘনত্বের পার্থক্য বেশি হলে একটি মাধ্যমের মধ্য দিয়ে শব্দ গিয়ে অন্য মাধ্যমে সহজে বিস্তার লাভ করতে পারে না।
গ্যাসীয় মাধ্যমে শব্দের বিস্তার একটি রুদ্ধতাপ প্রক্রিয়া
আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর কিছুক্ষণ পরে শব্দ শোনা যায়। কারণ শব্দের পৃথিবীতে আসতে আলোর চেয়ে বেশি কিছু সময় লাগে।
বায়ুতে 1 ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বাড়লে শব্দের বেগ প্রতি সেকেন্ডে প্রায় 61 মিটার বাড়ে।
উৎসের ও শ্রোতার কাছে মধ্যে দূরত্ব যত বাড়ে শব্দের প্রাবল্য তত বাড়ে।
WHO নির্ধারিত নিরাপদ শব্দের তীব্রতর মাত্রা 45 ডেসিবেল।
Pingback: ইমালসন কি? | ইমালসনের প্রকারভেদ | ইমালসনের ব্যবহার – Studious
Pingback: স্থিতিস্থাপকতা (Elasticity) কাকে বলে? | পীড়ন কি | বিকৃতি কি – Studious