ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসে একটি গুরত্বপূর্ণ ঘটনা। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা যেমন wbcs, ssc, RRB ইত্যাদি তে ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ বিভিন্ন প্রশ্নের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। আজ আমরা আলোচনা করবো প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল, দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল ও তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল।
প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৭৭৫-১৭৮২)
পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে ( ১৭৬১ খ্রিঃ ) শােচনীয় পরাজয়ের পর মারাঠা শক্তি সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পেশােয়া মাধব রাও – এর আমলে ( ১৭৬২-১৭৭২ খ্রিঃ ) মারাঠারা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা ১৭ বছর বয়স্ক নারায়ণ রাও সিংহাসনে বসেন। তার পিতৃব্য রঘুনাথ রাও ছিলেন খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও স্বার্থপর। তিনি নারায়ণ রাও – কে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন। সখারাম বাপু , নানা ফড়নবিশ ও অন্যান্য মারাঠা নেতারা তাকে মানতে রাজি ছিলেন না। তারা রঘুনাথ রাও-কে সিংহাসন থেকে বিতাড়িত করেন এবং মৃত নারায়ণ রাও – এর শিশুপুত্র দ্বিতীয় মাধব রাও বা মাধব রাও নারায়ণ – কে সিংহাসনে বসান। রঘুনাথ রাও তখন বােম্বাই – এর ইংরেজ কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হন এবং দুপক্ষে সুরাটের সন্ধি ( ১৭৭৫ খ্রিঃ ) স্বাক্ষরিত হয়। রঘুনাথের পক্ষ নিয়ে ইংরেজ সেনাদল পুনায় ঢুকে পড়ে। এভাবে প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের সূচনা হয় ( ১৭৭৫ খ্রিঃ )। কয়েক বছর যুদ্ধ চলার পর ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে সলবাই – এর সন্ধি দ্বারা প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ বন্ধ হয়।
সলবাই সন্ধির শর্তানুসারে
(১) ইংরেজরা মাধব রাও নারায়ণকে পেশােয়া ’ বলে স্বীকার করে ও রঘুনাথ রাও – এর পক্ষ ত্যাগ করে।
(২) এছাড়া, তারা সলসেট , বেসিন ও বােম্বাই – সন্নিহিত কিছু স্থান লাভ করে।
এরপর দীর্ঘ কুড়ি বছর দুপক্ষে আর কোনাে যুদ্ধ হয়নি। কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিক লুয়ার্ড বলেন যে , সলবাই-এর সন্ধি দ্বারা কোম্পানি মারাঠা শক্তিকে ধ্বংস করে ফেলে।
ইংরেজ ঐতিহাসিক স্পিয়ার – এর মতে “ প্রথম মারাঠা যুদ্ধের সূচনা ছিল অপ্রয়ােজনীয় এবং এর পরিচালনা ছিল দুর্ভাগ্যজনক”। (The first Maratha war must be regarded as unnecessary in its inception and unfortunate in its handling )। এইভাবে মারাঠা ও মহীশূর রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার ইংরেজ শক্তিকে এক সর্বভারতীয় শক্তিতে পরিণত করেন।
কারা , এলাহাবাদ ও অযােধ্যা: ক্লাইভের সঙ্গে মােগল সম্রাট শাহ আলমের এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় ।
(১) হেস্টিংস এই সন্ধি নাকচ করে শাহ আলমের বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা ভাতা এবং কারা ও এলাহাবাদ জেলার ওপর তার অধিকার কেড়ে নেন।
(২) বারাণসীর সন্ধি ( ১৭৭৩ খ্রিঃ ) দ্বারা তিনি অযােধ্যার নবাবকে ইংরেজদের অধীনস্থ মিত্রে পরিণত করেন।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮০২-১৮০৫)
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে মারাঠা রাজ্যে নানা অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এ সময় ভোসলে , গাইকোয়াড় , হােলকার , সিন্ধিয়া প্রমুখ সামন্তপ্রভুরা কার্যত স্বাধীন হয়ে ওঠেন। তাদের মধ্যে সর্বদাই অন্তর্দ্বন্দ্ব চলত । ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে নানা ফড়নবিশের মৃত্যুর পর এই অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও জটিল আকার ধারণ করে। দুর্বলচিত্ত পেশােয়া দ্বিতীয় বাজিরাও – এর পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি এই অন্তর্দ্বন্দ্বে নানা সময় নানা পক্ষকে ইন্ধন জোগাতেন। ক্ষুব্ধ হােলকার তার রাজধানী পুনা আক্রমণ করে তাকে সেখান থেকে বিতাড়িত করেন এবং জনৈক অমৃত রাও – কে পেশােয়ার গদিতে বসান । পরাজিত পেশােয়া দ্বিতীয় বাজিরাও তখন ইংরেজদের শরণাপন্ন হন এবং রাজ্য পুনরুদ্ধারের আশায় ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে বেসিনের সন্ধি দ্বারা অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। বেসিনের সন্ধি ছিল মারাঠাদের কাছে চূড়ান্ত অপমান। এই সন্ধি মারাঠা জাতির মর্যাদাকে ধূলায় লুণ্ঠিত করে। সিন্ধিয়া ও ভোঁসলে এই সন্ধি মানতে রাজি ছিলেন না। পেশােয়া বাজিরাও – ও মনে – প্রাণে এই সন্ধি মানতে পারেননি। তিনি সিন্ধিয়া ও ভোঁসলেকে গােপনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উৎসাহিত করতে থাকেন। সিন্ধিয়া ও ভোঁসলে কোম্পানির মিত্র নিজামের রাজ্য আক্রমণ করলে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ ( ১৮০৩-০৫ খ্রিঃ ) শুরু হয়। কয়েকটি যুদ্ধে পর পর পরাজিত হয়ে সিন্ধিয়া ও ভোসলে যথাক্রমে সুরজ-অর্জুন গাঁও ও দেওগাঁও – এর সন্ধি ( ১৮০৩ খ্রিঃ ) স্বাক্ষর করেন এবং অধীনতামূলক মিত্ৰতা চুক্তি মেনে নেন। এর ফলে কটক, বালেশ্বর , মধ্যভারতের কিছু অংশ , আহম্মদনগর , গঙ্গা – যমুনার দোয়াব অঞ্চল প্রভৃতি স্থানগুলির ওপর ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বেসিনের সন্ধি ও দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ পর ইংরেজ শক্তি কার্যত ভারতে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে।
তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৮১৭-১৮১৮)
লর্ড ওয়েলেসলির আমলের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ ( ১৮১৭-১৯ খ্রিঃ )। অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি মেনে নিলেও ব্রিটিশ কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হবার জন্য পেশােয়া, সিন্ধিয়া ও ভোঁসলে সচেষ্ট ছিলেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সব সংবাদই অবহিত ছিল। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ পেশােয়াকে অতি অপমানজনক পুনার সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করেন। এই সন্ধি দ্বারা পেশােয়া পদ বিলুপ্ত করা হয় এবং তিনি ইংরেজদের বৃত্তিভােগীতে পরিণত হন। পেশােয়া এবং মারাঠা নেতৃমণ্ডলীর পক্ষে এই অপমানজনক সন্ধি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল। পেশােয়া বিদ্রোহ ঘােষণা করলে সিন্ধিয়া , ভোঁসলে , হােলকার প্রমুখ মারাঠা নেতৃবৃন্দও তার সঙ্গে যােগদান করেন। তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ তে তারা পরাজিত হন। পেশােয়া পদ লুপ্ত করে তাঁর রাজ্য কোম্পানির সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়। হােলকার অধীনতামূলক মিত্ৰতা চুক্তিতে আবদ্ধ হন এবং ভোসলের রাজ্য ইংরেজ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। সিন্ধিয়ার প্রভাবাধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজপুত রাজ্যগুলি ( উদয়পুর , জয়পুর , যােধপুর , কোটা , বুন্দি , প্রতাপগড় ) ১৮১৬-২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইংরেজদের সঙ্গে অধীনতামুলক মিত্রতা নীতিতে আবদ্ধ হওয়ায় রাজপুতানায় ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ তে মারাঠা শক্তির পতন হয় এবং ইংরেজ শক্তি ভারতে অপ্রতিহত হয়ে ওঠে। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পাঞ্জাব ও সিন্ধু ব্যতীত ভারতের সকল রাজ্যই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এর কিছু অংশ ব্রিটিশরা প্রত্যক্ষভাবে শাসন করত, আবার কিছু অংশ ছিল ব্রিটিশের অধীনস্থ মিত্রদের হাতে।
ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ সম্পর্কিত এই পোস্ট টি ভালো লাগলে comment করতে ভুলবেন না।
image: Wikipedia.org
Pingback: ভারতীয় সংবিধান রচনার ইতিহাস | ভারতীয় সংবিধান – Studious