চুয়াড় বিদ্রোহ (মেদিনীপুর, ১৭৯৮-১৭৯৯খ্রি.) আদিবাসী চুয়াড় বা চোয়াড় জনগোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ ও বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে বসবাস করত। চুয়াড়রা কৃষিকাজ ও পশুশিকারের পাশাপাশি স্থানীয় জমিদারদের অধীনে পাইক বা সৈনিকের কাজ করত। জমিদারের কাজের বিনিময়ে তারা কিছু নিষ্কর জমি ভোগ করত। আঠারো দ্বিতীয়ার্ধে চুয়াড়রা ইংরেজদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ শুরু করে তা ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’(Chuar rebellion) নামে পরিচিত।
চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ
মেদিনীপুরের জমিদারদের ওপর ইংরেজ কোম্পানি করের বোঝা বাড়িয়ে দিলে জমিদারের পক্ষ নিয়ে চুয়াড়রা প্রথম পর্যায়ের বিদ্রোহে অংশ নেয়। ঘাটশিলায় ধলভূমের রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম এই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। প্রথম পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে ইংরেজরা দরিদ্র চুয়াড়দের জমির মালিকানা বাতিল ও পাইকের পেশা থেকে বিতাড়িত করে। ফলে তাদের দুর্দশা আরও বাড়ে এবং তারা ইংরেজদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়।
জঙ্গলমহল-সহ মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দ্বিতীয় পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহে রায়পুরের নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন বাঁকুড়ার জমিদার দুর্জন সিংহ, মেদিনীপুরের রানি শিরোমণি প্রমুখ। তাঁরা বিভিন্ন জমিদার ও আদিবাসী চুয়াড়দের বিদ্রোহে শামিল করেন। বিদ্রোহীরা সরকারি দপ্তরে আক্রমণ চালায়। বিদ্রোহে অসামান্য অবদানের জন্য রানি শিরোমণি ‘মেদিনীপুরের লক্ষ্মীবাই‘ নামে পরিচিত হন। বিদ্রোহী চুয়াড়রা ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শেষপর্যন্ত পরাজিত হয়। ইংরেজ পুলিশবাহিনী বিদ্রোহীদের ওপর তীব্র দমনপীড়ন চালায় এবং রানি শিরোমণিকে হত্যা করে। এর ফলে চুয়াড় বিদ্রোহ থেমে যায়।
চুয়াড় বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য
চুয়াড় বিদ্রোহের (Chuar rebellion) বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ছিল।
প্রথমত, বিদ্রোহী চুয়াড়রা ছিল সশস্ত্র উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। অস্ত্রচালনা ও যুদ্ধ ছিল তাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য।
দ্বিতীয়ত, ইংরেজ কোম্পানি মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও ধলভূম অঞ্চলের স্থানীয় জমিদারদের ওপর ভূমি রাজস্বের বোঝা বাড়িয়ে দেয় এবং রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ জমিদারদের জমিদারি বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করে। ফলে জমিদাররা বিদ্রোহ শুরু করে এবং চুয়াড়রাও জমিদারদের পক্ষ নিয়ে বিদ্রোহে যোগ দেয়।
তৃতীয়ত, চুয়াড় বিদ্রোহ দুটি পর্যায়ে সংঘটিত হয়। প্রথম পর্যায়ে চুয়াড় বিদ্রোহ ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের চুয়াড় বিদ্রোহ ১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়।
আরও পড়ুন
- সিপাহী বিদ্রোহ 1857 (মহাবিদ্রোহ) | সিপাহী বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল
- সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলির বৈশিষ্ট্য – Indus Civilization
- অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি বলতে কি বোঝায়?
- ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (Anglo-Maratha War) | ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের কারন
চুয়াড় বিদ্রোহের ফলাফল
চুয়াড় বিদ্রোহের (Chuar rebellion) ব্যর্থ হলেও এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল লক্ষ করা যায়। যেমন —
প্রথমত, ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে পিছিয়ে পড়া চুয়াড়রা বিদ্রোহ শুরু করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। কেন না, নিরক্ষর চুয়াড়রা আঠারো শতকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ শুরু করে তা ভারতের শিক্ষিত সম্প্রদায় শুরু করেছিল আরও অন্তত একশো বছর পরে।
দ্বিতীয়ত, জমিদার কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই বিদ্রোহে শামিল হয়।
তৃতীয়ত, চুয়াড়দের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সরকার এখানকার শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটায়। বিষ্ণুপুর শহরটিকে কেন্দ্র করে দুর্গম বনাঞ্চল নিয়ে ‘জঙ্গলমহল‘ নামে একটি বিশেষ জেলা গঠন করা হয়।
Covered Topics: Chuar rebellion 1798, চুয়াড় কারা?, চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ কি ছিল? চুয়াড় বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য, চুয়াড় বিদ্রোহের pdf, চুয়াড় বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল, চুয়াড় কাদের বলা হত?, চুয়াড় বিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র কোথায়?
Pingback: কোল বিদ্রোহ | কোল বিদ্রোহের কারণ | কোল বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল – Studious
Pingback: সাঁওতাল বিদ্রোহ | সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ | বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি | সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্
Pingback: মুন্ডা বিদ্রোহ | মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ | মুন্ডা বিদ্রোহের ফলাফল – Studious
Pingback: সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ | সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের কারণ – Studious
চুয়াড় বলতে মূলত ভূমিজ আদিবাসীদের বোঝায়