হ্যালো বন্ধুরা, আজ আপনাদের আলোচ্য বিষয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা “ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ “। আজ আমরা জানবো প্রথম, দ্বিতীয় , তৃতীয় ও চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল। মাদ্রাজের সন্ধি কবে ও কার কার মধ্যে হয়?, ম্যাঙ্গালােরের সন্ধি কবে ও কার কার মধ্যে হয়?, শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি কবে ও কার কার মধ্যে হয় ? ইত্যাদি।
পলাশির যুদ্ধের ( ১৭৫৭ খ্রিঃ ) ফলে বাংলা – বিহার ও উড়িষ্যার ওপর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বক্সারের যুদ্ধ ( ১৭৬৪ খ্রিঃ ) উত্তর ভারতের এক বিশাল অংশে কোম্পানিকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তােলে । দেওয়ানি ‘ অর্জনের ( ১৭৬৫ খ্রিঃ ) ফলে বাংলার ওপর কোম্পানির আধিপত্য আইনগত বৈধতা পায় এবং বাংলার নবাব কোম্পানির বৃত্তিভােগীতে পরিণত হয়। দ্বৈতশাসন ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তর – এর ফলে বাংলার বুকে চরম নৈরাজ্য নেমে আসে । এসময় ভারতে ব্রিটিশশক্তির সম্প্রসারণ কিছুদিন স্থগিত থাকলেও পুনরায় শুরু হয় । বাংলাকে কেন্দ্র করেভারতে কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৬৭-১৭৬৯ খ্রি:)
১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভেরেলেস্ট ( ১৭৬৭-৬৯ খ্রিঃ ) গভর্নর হয়ে বাংলায় আসেন। এসময় ভারতে মারাঠা ও মহীশূর রাজ্য ছিল ইংরেজদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং ভারতে ইংরেজ শক্তিরসম্প্রসারণের পথে প্রধান অন্তরায়। এ সময় মহীশূরে হায়দার আলি ( ১৭৬১-৮২ খ্রিঃ ) নামে একভাগ্যান্বেষী সৈনিকের উত্থান ঘটে। সাধারণ একজন সৈনিক হিসেবে জীবন শুরু করলেও নিজ প্রতিভাবলে তিনি মহীশূর রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন ( ১৭৬১ খ্রিঃ )। তার উত্থানে দাক্ষিণাত্যের অপর তিনশক্তি — ইংরেজ , মারাঠা, ওহায়দ্রাবাদের নিজাম, আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং হায়দারের বিরুদ্ধে তারা একটি শক্তিজোট গঠন করে ( ১৭৬৬ খ্রিঃ )। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে হায়দার ইংরেজদের আশ্রিত কর্ণাটকের নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলে প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ( ১৭৬৭-৬৯ খ্রিঃ ) শুরু হয়। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে হায়দার আলি অতর্কিতে বিশাল সেনাদল নিয়ে দাক্ষিণাত্যে ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি মাদ্রাজের উপকণ্ঠে হাজির হন। ইংরেজরা তখন হায়দার – প্রদত্ত শর্তে সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এই সন্ধি মাদ্রাজের সন্ধি ( ১৭৬৯ খ্রিঃ ) নামে পরিচিত।
মাদ্রাজের সন্ধির শর্ত অনুসারে স্থির হয় যে
( ১ ) একে অন্যের অধিকৃত স্থানগুলি । পরস্পরকে ফিরিয়ে দেবে।
(২ ) এক পক্ষ অপর কোনাে তৃতীয় শক্তিদ্বারা আক্রান্ত হলে অন্য পক্ষ তাকে সাহায্য করবে ।
এইভাবে প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই সন্ধি ছিল সাময়িক যুদ্ধবিরতি মাত্র। এর দ্বারা দুপক্ষের মধ্যে স্থায়ী কোনাে সদ্ভাব স্থাপিত হয়নি বা সমস্যারও কোনাে স্থায়ী সমাধান হয়নি। এছাড়া , এই সন্ধি ইংরেজদের কাছে ছিল তীব্র অপমানজনক।
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৮০-১৭৮৪ খ্রি:)
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর হয়ে ভারতে আসেন। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা মহীশূরের অন্তর্গত ফরাসি বাণিজ্যকেন্দ্র মাহে দখল করলে হায়দার ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। এইভাবে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ( ১৭৮০-৮৪ খ্রিঃ ) শুরু হয়।
যুদ্ধ চলাকালে হায়দার আলির মৃত্যু ঘটলে ( ১৭৮২ খ্রিঃ ), তার বীরপুত্র টিপুসুলতান ( ১৭৮২-৯৯খ্রিঃ ) বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যান ।
১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাঙ্গালােরের সন্ধি দ্বারা দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশুর যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং একে অন্যের অধিকৃত স্থানগুলি পরস্পরকে ফেরত দেয়। ওয়ারেন হেস্টিংস এই সন্ধিকে ‘ অপমানজনক শান্তি ’ (humiliating pacification ) বলে অভিহিত করেন।
তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯০-১৭৯২ খ্রি:)
লর্ড কর্নওয়ালিস – এর আমলে ইঙ্গ-মহীশূর সম্পর্ক আবার তিক্ত হয়ে ওঠে। ইংরেজ ও মহীশূর – দু’পক্ষই জানত যে , ম্যাঙ্গালােরের সন্ধি সাময়িক যুদ্ধবিরতি মাত্র। এজন্য দু’পক্ষই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে টিপুসুলতান ইংরেজদের মিত্ররাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করলে তৃতীয় ইঙ্গ – মহীশূর যুদ্ধ শুরু হয়। নিজাম ও মারাঠারা ইংরেজ পক্ষে যােগদান করে। দুবছর ধরে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের পর ত্রি-শক্তি জোটের কাছে টিপু পরাজিত হন। তার রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তম অধিকৃত হয় এবং তিনি শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি ( ১৭৯২ খ্রিঃ ) স্বাক্ষরে বাধ্য হন।
শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি তে বলা ছিল
(১) টিপু তার রাজ্যের অর্ধাংশ ইংরেজদের ছেড়ে দেন। নিজাম , মারাঠা ও ইংরেজরা এই অংশটি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।
(২) টিপু ইংরেজদের ৩ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণদিতে সম্মত হন। ক্ষতিপূরণের টাকার জামিন হিসেবে তিনি তার দুই পুত্রকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেন। এই সন্ধির দ্বারা দাক্ষিণাতাে ইংরেজ শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ (১৭৯৯ খ্রি:)
লর্ড ওয়েলেসলির আমলে উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ। তিনি টিপু সুলতানকে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বললে তিনি এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ ( ১৭৯৯ খ্রিঃ ) শুরু হয়।
মহীশূর শার্দুল ’ টিপু সুলতান শ্রীরঙ্গপত্তমের সন্ধি মানতে পারেননি। এ কারণে তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ইংরেজ ও নিজামের যুগ্মবাহিনী মহীশূর আক্রমণ করে ( ১৭৯৯ খ্রিঃ )। পর পর দুটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে টিপু তার রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তমে আশ্রয় নেন।
শত্রুপক্ষ রাজধানী অবরােধ করে এবং তিনি যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। তার মৃত্যুতে স্বাধীন মহীশূর রাজ্যের পতন ঘটে এবং মহীশূরের একাংশে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে ইংরেজরা ভারতে তাদের এক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত থেকে রক্ষা পায়।
জনৈক ঐতিহাসিকের মতে সামরিক , অথনৈতিক ও শান্তিকারী ব্যবস্থা হিসেবে মহীশূর জয় হল ক্লাইভের পরবর্তীকালে অর্জিত ইংরেজদের সর্বাধিক সাফল্য। এই যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা এক প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুর হাত থেকে অব্যাহতি পায় । ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের ক্ষেত্রে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজরা প্রথম বাধাটি অতিক্রম করে , শ্রীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধে দ্বিতীয় বাধাটি অতিক্রান্ত হয়। ফরাসিরা ভারতে তাদের শেষ ও নির্ভরযােগ্য মিত্রের সহযােগিতা ও সাহায্য থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়।
বলা যেতে পারে যে , এই যুদ্ধটি ছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে ফরাসিদের বাধাদান প্রচেষ্টার স্থায়ী বিলুপ্তি।
image: Wikipedia.org
Pingback: ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (Anglo-Maratha War) | ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের কারন – Studious
Pingback: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি? | চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল ও সুফল – Studious