ইতিহাসের আগের পোস্ট গুলিতে আমরা আলোচনা করেছিলাম চুঁয়ার বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ সম্পর্কে। আজ আমরা আলোচনা করবো নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে। জানবো নীল বিদ্রোহের কারণ, নীল বিদ্রোহের ফলাফল, নীল বিদ্রোহের ফলাফল ইত্যাদি।
নীল বিদ্রোহ (Indigo Revolt) – 1859
ইউরোপে কৃত্রিম নীল আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রভৃতি দেশের খামার মালিকরা ভারতে নীলের লাভজনক। ব্যাবসা করতে আসত। বাংলা ও বিহারে ১৭৮২-৮৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নীলচাষ শুরু হয়। বাংলার নদিয়া, যশোহর, পাবনা, রাজশাহি, ময়মনসিংহ, মালদহ প্রভৃতি জেলায় প্রচুর পরিমাণ নীলের চাষ হত। ইউরোপ থেকে আগত শ্বেতাঙ্গ খামার মালিকরা এদেশে জমি কিনে বা লিজ নিয়ে নীলচাষ করত এবং উৎপাদিত নীল ইউরোপে রপ্তানি করে যথেষ্ট লাভবান হত। এই কারণে নীলকর সাহেবরা বাংলার চাষিদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার করে তাদের নীল চাষ করার জন্য বাধ্য করত। এই ধরনের চরম অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার নীলচাষিরা ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলে, যা ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।
নীল বিদ্রোহের কারণ
ভূমিকা : সর্বপ্রথম ভারতে নীলশিল্প প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ বণিক কার্ল ব্ল্যাম। পরবর্তীকালে ইউরোপীয় নীলকরদের তীব্র অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার চাষিরা বিদ্রোহ করে। এই বাংলায় নীল বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন—
(1) নীলচাষের প্রণালী: বাংলায় মূলত দুটি পদ্ধতিতে নীলচাষ হত—
- i). এলাকা চাষ= এলাকা চাষের ক্ষেত্রে নীলকররা নিজেদের খাস জমিতে দূর থেকে সস্তায় শ্রমিক এনে নীলচাষ করত। ক্ষেত্রে প্রতি ১০ হাজার বিঘা জমিতে নীলচাষের জন্য খরচ পড়ত আড়াই লক্ষ টাকা। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার একটি নীলকুঠি
- ii). বে-এলাকা বা রায়তি চাষ : বে-এলাকা বা রায়তি চাষের ক্ষেত্রে নীলকররা চাষিকে অগ্রিম অর্থ দিতে চাষির নিজের জমিতে নীলচাষে বাধ্য করত। রায়তি চাষে জমি , লাঙল , সার , বীজ ও অন্যান্য সব খরচ চাষিকেই বহন করতে হত। ফলে এই পদ্ধতিতে প্রতি ১০ হাজার বিঘা জমিতে নীলচাষের জন্য খরচ পড়ত মাত্র ২০ হাজার টাকা। তাই নীলকররা সর্বদা চাষিকে বে – এলাকা বা রায়তি চাষে বাধ্য করত।
(2) দাদনী প্রথা : নীলকররা নীলচাষের জন্য চাষিকে বিঘা পিছু মাত্র ২ টাকা অগ্রিম দাদন দিত। কোনো চাষি একবার দাদন নিলে তা আর কখনোই নীলকরের খাতায় পরিশোধ হত না। আবার দাদন না নিলে চাষির গোরুবাছুর নীলকুঠিতে নিয়ে আটকে রাখা হত।
(3) জমির মাপে কারচুপি : নীলকরের কাছ থেকে দাদন নিয়ে যে জমিতে চাষিকে নীলচাষ করতে হত তা মাপের সময় নীলকররা ব্যাপক কারচুপি করত। তারা গড়ে প্রতি আড়াই বিঘা জমিকে ১ বিঘা বলে গণ্য করত। ফলে চাষিকে নীলচাষে নিজের প্রচুর জমি ব্যবহার করতে হত।
(4) চাষির লোকসান : নীলচাষ করে চাষির প্রচুর আর্থিক লোকসান হত। নীল কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, এক বিঘা জমিতে নীলচাষে চাষির খরচ পড়ত ১৩ টাকা ৬ আনা। সেই নীল বিক্রি করে চাষি পেত মাত্র ৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বিঘা নীলচাষে চাষির লোকসান হত ৭ টাকা ৬ আনা।
(5) অত্যাচার : নীলকর সাহেবরা ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং অত্যাচারী। তাঁরা নীলচাষ করতে না চাইলে নীলকরদের লাঠিয়াল , পাইক , বরকন্দাজ প্রমুখ চাষিকে নীলকুঠিতে এনে আটকে রাখত এবং চাষিদের ওপর নির্মম দৈহিক অত্যাচার চালাত। চাষির স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যান্যদের ওপরও নানা ধরনের নিষ্ঠুর অত্যাচার চালানো হত। এমনকি চাষির বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হত।
(6) ইংরেজ শাসকদের অবিচার : অত্যাচারিত চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে ইংরেজ শাসকদের কাছে অভিযোগ জানিয়ে কখনও ন্যায়বিচার পেত না। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীরা বিচারে তাদের স্বজাতীয় শ্বেতাঙ্গদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করত। সমকালীন সংবাদপত্রে দেখা যায় যে , আদালতের কাঠগড়ায় নীলকররা বসার চেয়ার পেতেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা নীলকরদের বাংলোতে আনন্দ – উৎসবে যোগ দিতেন । ফলে বিচারব্যবস্থাও নীলচাষিদের বিপক্ষে চলে গিয়েছিল।
(7) চাষিদের দুর্দশা : নীলকর সাহেবরা চাষিকে ধানচাষের পরিবর্তে জমিতে নীলচাষে বাধ্য করত। ফলে চাষির ধান উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং চাষির ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এদিকে নীলচাষ করে চাষি আর্থিক লোকসানের শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হয়। ফরিদপুরের ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট নীল কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে, “ ইংল্যান্ডে নীলের যে সকল বাক্স পৌঁছায় তা বাংলার চাষির রক্তে রঞ্জিত। ”
আরও পড়ুন:
- সিপাহী বিদ্রোহ 1857 (মহাবিদ্রোহ) | সিপাহী বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল
- চুয়াড় বিদ্রোহ ১৭৯৮ – Chuar Rebellion 1798
- কোল বিদ্রোহ | কোল বিদ্রোহের কারণ | কোল বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল
- সাঁওতাল বিদ্রোহ | সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ | বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি | সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব
নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব
বাংলার অত্যাচারিত নীলচাষিদের উদ্যোগে সংঘটিত নীল বিদ্রোহ ( ১৮৫৯-৬০ খ্রি ) উনিশ শতকে ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। এই বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যেমন—
1) স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ : নীল বিদ্রোহ ছিল নীলকরদের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের গুরুত্ব সম্পর্কে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ – য় মন্তব্য করা হয়েছে যে, নীল বিদ্রোহ দেশের মানুষকে রাজনৈতিক চেতনা ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শিক্ষা দিয়েছিল।
2) শিক্ষিত সম্প্রদায়ের নজর : নীল বিদ্রোহকে উপলক্ষ্য করে বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গ্রামগঞ্জের সাধারণ। গরিব মানুষ ও কৃষকদের প্রতি নজর দেয়। ফলে শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে নীল বিদ্রোহ ও বিদ্রোহীদের সংযোগ ঘটে।
3) রাজনৈতিক চেতনা : নীল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইংরেজ সরকারের অত্যাচার ও শোষণের আসল রূপ শিক্ষিত সমাজের চোখে ধরা পড়ে। এর ফলে দেশবাসীর রাজনৈতিক চেতনাও বৃদ্ধি পায়।
4) হিন্দু-মুসলিম ঐক্য : নীল বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বাংলায় হিন্দু – মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের চাষিরা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং একসঙ্গে আন্দোলনে শামিল হয়।
5) গান্ধিজির আন্দোলনের অগ্রদূত : নীল বিদ্রোহকে বিশ শতকে গান্ধিজির নেতৃত্বে পরিচালিত অহিংস অসহযোগ ( ১৯২০-২২ খ্রি) ও আইন অমান্য আন্দোলনের ( ১৯৩০-৩৪ খ্রি) অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীকালে সম্ভবত নীল বিদ্রোহের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই গান্ধিজি বিহারের চম্পারনে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন।
6) জাতীয়তাবোধ : নীল বিদ্রোহ সামন্তপ্রথা ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করে । শিশির ঘোষের ভাষায় , “ এই নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম দেশের লোককে রাজনৈতিক আন্দোলনের ও সংঘবদ্ধ হবার প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দেয়। ” এই বিদ্রোহ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে শেষপর্যন্ত তা স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত করে।
7) নীল কমিশন : নীল বিদ্রোহের ফলে সরকারও নড়েচড়ে বসে। বিদ্রোহের পর নীলচাষিদের ক্ষোভের কারণ অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে তৎকালীন বাংলার ছোটোলাট জন পিটার গ্রান্ট ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ ( ৩১ ডিসেম্বর ) নীল কমিশন গঠন করে। কমিশনের রিপোর্টে নীলচাষিদের ওপর অত্যাচারের বহু তথ্য উঠে আসে।
নীল বিদ্রোহের ফলাফল
১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে শক্তিশালী বিদ্রোহ গড়ে তোলে। এই বিদ্রোহের ফলাফলগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেমন—
1) নীল কমিশন : বিদ্রোহের পর সরকার ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে নীল কমিশন গঠন করে। কমিশনের রিপোর্ট থেকে নীলকরদের চরম অত্যাচার ও নির্যাতনের কাহিনি প্রকাশিত হয়। ফরিদপুরের ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট নীল কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে , “ ইংল্যান্ডে নীলের যে সকল বাক্স পৌঁছায় তা বাংলার চাষির রক্তে রঞ্জিত। ”
2) অষ্টম আইন : সরকার ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ অষ্টম আইন’ এর দ্বারা ‘ নীলচুক্তি আইন ’ বাতিল বলে ঘোষণা করে এবং জানায় যে , নীলচাষ সম্পূর্ণভাবে চাষিদের ইচ্ছাধীন।
3) যোগসূত্র : নীল বিদ্রোহ নীলকরদের এবং তাদের রক্ষক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয় । এই বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের চাষিদের মধ্যে , চাষি ও জমিদারদের মধ্যে, শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে ওঠে।
4) জাতীয় চেতনার উন্মেষ : নীল বিদ্রোহ পরোক্ষভাবে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। নীলকরদের অত্যাচার, ‘ নীলদর্পণ ‘ নাটকের মর্মস্পর্শী বিবরণ, লং সাহেবের কারাবাস, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু প্রভৃতি এই জাতীয় চেতনাকে শক্তিশালী করে।
5) মহাজনদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি : মার্কিন ঐতিহাসিক ব্লেয়ার ক্লিং মনে করেন যে, নীলকরদের পতনের ফলে নিম্নবঙ্গের কর্তৃত্ব সুদখোর মহাজনদের হাতে চলে যায়।
Covered Topics: নীল বিদ্রোহ বলতে কি বোঝায়?, নীল বিদ্রোহের কারণ, নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব, নীল বিদ্রোহের ফলাফল, নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব,
Mcq