হ্যালো বন্ধুরা আজ আমরা আবার হাজির হয় ছি ইতিহাসের একটি গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় নিয়ে। বিষয় টি হলো শিল্প বিপ্লব। আজ আমার জানবো “শিল্প বিপ্লব বলতে কি বোঝায়?”, ” ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণ কি বা ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব কেন হয়েছিল ?”, শিল্প বিপ্লবের সুফল, শিল্প বিপ্লবের কুফল”, ইত্যাদি।
শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution) বলতে কি বোঝায়?
শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি ও তার গুণগত মানের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক উন্নতি হয়, তাকেই সাধারণভাবে ‘ শিল্প বিপ্লব ’ ( Industrial Revolution ) বলা হয়। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সমাজতন্ত্রী নেতা লুই অগাস্তে ব্ল্যাঙ্কি ( Louis Auguste Blanqui ) শিল্প বিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন।
১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় শিল্প বিপ্লব কথাটি ব্যবহার করেন জার্মান সমাজতন্ত্রী দার্শনিক ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ( Friedrich Engels )। তবে ১৮৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দে শিল্প বিপ্লব কথাটিকে জনপ্রিয় করেছিলেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি ( Arnold Toynbee )।
ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণ কী ?
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব : ইউরােপের মধ্যে ইংল্যান্ডেই প্রথম শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়। ফ্রান্স , জার্মানি , হল্যান্ড , রাশিয়ার তুলনায় ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার কারণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা একমত নন। তাঁদের মতে , শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার জন্য বিভিন্ন উপাদানের প্রয়ােজন হয়। আর ইংল্যান্ডে সেই উপাদানগুলির সবকটিই উপস্থিত থাকায় শিল্পবিপ্লব ত্বরান্বিত হয়েছিল।
ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণ:
ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটার পিছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান ছিল—
1) ইংল্যান্ডের ভৌগােলিক পরিবেশ এবং জলবায়ু শিল্পবিপ্লবের অনুকূল ছিল।
2 ) ইংল্যান্ডের সমকালীন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইংল্যান্ডকে ফ্রান্স ও জার্মানির থেকে এগিয়ে রেখেছিল।
3) ইংল্যান্ডে প্রচলিত বেষ্টনী প্রথা ( Enclosure System ) -এর ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যা শহরের কলকারখানাগুলিতে শ্রমিকের চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়েছিল।
4) কৃষিতে ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধি শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি প্রস্তুত করে দিয়েছিল।
5) এশিয়া , আফ্রিকা এবং উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত ব্রিটিশ উপনিবেশগুলি একদিকে যেমন কাঁচামাল এবং মূলধনের জোগান দিয়েছিল , তেমনি উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির বাজার হিসেবেও ইংল্যান্ডকে সুবিধা প্রদান করেছিল ।
6) ইংল্যান্ডের উদার সমাজ এবং বহির্বাণিজ্যের ব্যাপক প্রবণতা শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্রে অনুকূল ছিল।
7) উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নত সমন্বয় শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল।
আরও পড়ুন:
অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি বলতে কি বোঝায়?
ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাল, তাদের প্রতিষ্ঠাতা
ভারতের গভর্নর জেনারেল, ভাইসরয় ও তাদের সময়কালের তালিকা
শিল্প বিপ্লবের সুফল
1) নগরকেন্দ্রিক সমাজ সৃষ্টি : শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্প বা কলকারখানা ও ব্যাবসাথলকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন নগরের সৃষ্টি হয়। গ্রামের কৃষক ও সাধারণ মানুষ অর্থ উপার্জন ও উন্নত জীবনযাপনের জন্য দলে দলে শহরে আসতে থাকে। এর ফলে নগরকেন্দ্রিক সমাজ ও সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়।
2) বিলাসবহুল জীবনযাপন : শিল্পবিপ্লবের ফলে পরিধেয় থেকে পরিবহন সর্বক্ষেত্রে আরাম ও বিলাসের অজস্র উপকরণ নির্মিত হতে থাকে। অর্থের বিনিময়ে সেইসব দ্রব্য ক্রয় করে মানুষ নিজেদের জীবনকে বিলাসবহুল করে তােলে।
3) প্রকৃতিকে জয় : শিল্পবিপ্লবের ফলে আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির দ্বারা মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিকে জয় করার কাজে লিপ্ত হয়। কয়লা , খনিজ তেল , জল প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বিদ্যুৎ তৈরিতে মানুষ সক্ষম হয়।
4) সময়ের সাশ্রয় : শিল্পবিপ্লবের ফলে কায়িক শ্রমের পরিবর্তে যন্ত্রের দ্বারা অল্প সময়ে অধিক দ্রব্য উৎপাদনে মানুষ সক্ষম হয়। এর ফলে সময়ের অনেক সাশ্রয় হয়।
5) শ্রমবিভাজন নীতির উদ্ভব : শিল্প বিপ্লব এর পূর্বে একজন শ্রমিক নিজে সম্পূর্ণ একটি দ্রব্য তৈরি করত। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের ফলে একটি দ্রব্য বিভিন্ন শ্রমিকের মিলিত শ্রমে তৈরি হয়। অর্থাৎ একজন শ্রমিক একটি দ্রব্যের একটি অংশ তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয় — পুরাে দ্রব্যের সঙ্গে নয়। ফলে বিশেষীকরণের ( Specialization ) উদ্ভব হয় এবং দ্রব্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।
6) ব্যাবসা বাণিজ্যের প্রসার : শিল্প বিপ্লব এর ফলে দ্রব্যের উৎপাদন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। ইংল্যান্ডের উৎপাদিত সামগ্রী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাজারে ছেয়ে গিয়েছিল।
শিল্প বিপ্লবের কুফল
শিল্প বিপ্লব মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। শিল্পবিপ্লব সমাজ , রাষ্ট্র ও অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। মানবসভ্যতার প্রগতির পথে শিল্পবিপ্লব ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু এই শিল্পবিপ্লব আশীর্বাদের সঙ্গে কিছু কিছু অভিশাপও বয়ে নিয়ে আসে।
শিল্পবিপ্লবের কুফল :
1) জনশূন্য গ্রাম : শিল্পবিপ্লবের ফলে গ্রামের মানুষ কাজের আশায় শহরে এসে ভিড় জমালে গ্রামগুলি জনশূন্য হয়ে পড়ে। লােকসংখ্যার অভাবে গ্রামগুলি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
2) কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন : শিল্পবিপ্লবের ফলে নতুন নতুন যন্ত্রের আবিষ্কার হয়। এইসব যন্ত্রের সাহায্যে কলকারখানায় অল্প সময়ে ব্যাপক উৎপাদন হলে কুটিরশিল্পগুলি ধ্বংসের মুখে পড়ে।
3) শােষক শ্রেণির আবির্ভাব : শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজে মালিক শ্রমিক — এই দুই নতুন শ্রেণির আবির্ভাব হয়। মালিকশ্রেণি শ্রমিকদের শােষণ করে মূলধনের পাহাড় জমা করে। এই কারণে মালিকশ্রেণি শােষক শ্রেণি হিসেবে বিবেচিত হয়।
4) মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির সংঘাত : কলকারখানার মালিকরা শ্রমিকদের শােষণ করে অধিক অর্থ উপার্জনে সচেষ্ট হয়। ফলে অত্যধিক কাজের চাপ , অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, অমানবিক আচরণ শ্রমিকদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তােলে এর ফলস্বরূপ শ্রমিক ও মালিকশ্রেণির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়।
5) ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা : শিল্পবিপ্লবের ফলে পণ্যের উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির জন্য ইংল্যান্ড – সহ ইউরােপের অন্যান্য কয়েকটি দেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়। ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে উপনিবেশ দখলের লড়াই শুরু হয়।
6) ঔপনিবেশিক শােষণ : শিল্প বিপ্লবের ফলে শিল্পমালিকেরা কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির জন্য উপনিবেশ বিস্তার করে। উপনিবেশের কাঁচামাল, ভূখণ্ড, জনসংখ্যা প্রভৃতির উপর শিল্পমালিকেরা আধিপত্য স্থাপন করে শােষণ চালাতে থাকে।
7) শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি : শিল্প বিপ্লবএর ফলে শ্রমিক ও মালিকশ্রেণির মধ্যে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ মালিকরা সর্বদা শ্রমিকদের শােষণ করে ধনী হয় এবং শ্রমিকরা শােষিত হতে হতে শােষণের শেষপ্রান্তে পৌছােয়।
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ইতিহাসের পাতায় একটি উল্লখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই পোস্ট টি তে শিল্প বিপ্লব সম্পর্কের তথ্য গুলি ভালো লাগল কমেন্ট এ জানাতে ভুলবেন না।
Read More »শিল্প বিপ্লব বলতে কি বোঝায়? | ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব