সাধারণত কোন তরলকে উত্তপ্ত করলে তার আয়তন বাড়ে এবং ঘনত্ব কমে। কিন্তু জলের ক্ষেত্রে উষ্ণতার একটি নির্দিষ্ট পাল্লায় এই নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়। কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ জলকে 0°C থেকে ধীরে ধীরে উত্তপ্ত করলে দেখা যায় যে 4°C উষ্ণতা পর্যন্ত জলের আয়তন না বেড়ে কমতে থাকে। এরপর উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য তরলের মতো জলে আয়তন প্রসারণ ঘটে এবং জলের ঘনত্ব কমে। অর্থাৎ 4 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতায় জলের আয়তন সবচেয়ে কম এবং ঘনত্ব সর্বাধিক হয়। আবার কিছু পরিমান গরম জল কে ধীরে ধীরে ঠান্ডা করলে দেখা যায় অন্যান্য তরলের মত 4° সেন্টিগ্রেড উষ্ণতায় না পৌঁছানো পর্যন্ত উষ্ণতা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে জলের আয়তন কমছে। কিন্তু 4°C থেকে 0°C পর্যন্ত উষ্ণতার পাল্লায় দেখা যায় যে উষ্ণতা কমে গেলেও জলের আয়তন না কমে বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে 0°C থেকে 4°C উষ্ণতায় জলের আচরণ অন্যান্য তরল পদার্থের আচরণ থেকে ভিন্ন। 0°C থেকে 4°C উষ্ণতায় মধ্যে জলের এই ভিন্ন ধরনের প্রসারণকে জলের ব্যতিক্রান্ত প্রসারণ বলা হয়।
1 গ্রাম জলের আয়তন এবং ঘনত্ব উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে পরিবর্তিত হয় তা নিচের লেখচিত্রের সাহায্যে দেখানো হয়েছে।


লেখচিত্র দুটি থেকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে আসা যায়
1) 0°C থেকে 4°C পর্যন্ত জলের আয়তন উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়। অর্থাৎ জলের ব্যতিক্রান্ত সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী নয়।
2) 4°C উষ্ণতায় জলের আয়তন সর্বনিম্ন এবং ঘনত্ব সর্বোচ্চ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য 0° সেন্টিগ্রেড থেকে 4° সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত জলের আয়তন প্রসারণ গুণাঙ্ক ঋণাত্মক।
3) 4° সেন্টিগ্রেড উষ্ণতার পরে জলের আয়তন প্রসারণ অন্যান্য তরলএর মত স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে। অর্থাৎ উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আয়তন বৃদ্ধি পায়।
4) 4° সেন্টিগ্রেড এর কাছাকাছি লেখচিত্র দুটি কিছুটা অনুভূমিক। এর থেকে বোঝা যায় যে 4° সেন্টিগ্রেড এর কাছাকাছি উষ্ণতার সামান্য পরিবর্তনের জন্য জলের আয়তনের বিশেষ পরিবর্তন ঘটে না। অর্থাৎ ঘনত্বেরও বিশেষ পরিবর্তন হয় না। সেইজন্য 4° সেন্টিগ্রেড উষ্ণতায় জলের ঘনত্ব একক ধরা হয়।
[আরও পড়ুন : বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস ও তাদের বর্ণনা]
জলচর প্রাণীর জীবনের ওপর জলের ব্যতিক্রান্ত প্রসারণ এর প্রভাব
জলের ব্যতিক্রান্ত প্রসারণ এর ফলে শীতপ্রধান দেশে নদনদী, হ্রদ, সমুদ্রের জল জমে বরফ হলেও মাছ ও অন্যান্য জলচর প্রাণীর বেঁচে থাকতে পারে।
শীতপ্রধান দেশে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা ক্রমশ 0° সেন্টিগ্রেড কিংবা আরো নিচে নেমে গেলে নদ-নদী, সমুদ্র, হ্রদ এবং অন্যান্য জলাশয়ের উপরের স্তর ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে ভারী হয়। উপরের ঠান্ডা ও ভারী জল নিচে নামে এবং নিচের অপেক্ষাকৃত গরম জল হালকা বলে উপরে উঠে যায়। যতক্ষণ নিচের জলের ঘনত্ব সর্বোচ্চ না হয় অর্থাৎ নিচের উষ্ণতা যতক্ষণ 4° সেন্টিগ্রেড না হয় ততক্ষণ জলের পরিচলন প্রবাহ চলতে থাকে। উপরের জল আরও ঠান্ডা হতে থাকলে অর্থাৎ 4 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর নিচে নেমে গেলে জলের ঘনত্ব কমে যায় এবং নিচে নামতে পারে না; ওপরে থেকেই ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে অবশেষে বরফে পরিণত হয়ে জলের উপর ভাসতে থাকে। নীচের জল 4 ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড উষ্ণতাতেই থেকে যায়। বরফ জলের চেয়ে হালকা বলে জলের উপরেই জমতে থাকে এবং জলের উপর একটি বরফের আস্তরণ সৃষ্টি হয়। বরফ তাপের কুপরিবাহী বলে নীচে থেকে বাইরের বায়ুমণ্ডলে তাপের পরিবহন খুব কম হয়। ফলে উপর থেকে তলদেশ পর্যন্ত জল জমে বরফ হতে পারে না। উপরে ভাসমান বরফের স্তর পুরু হতে থাকলেও নীচে জল থাকে। বরফের নীচে জলের উষ্ণতা থাকে 0 ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। নীচের দিকে জলের উষ্ণতা ক্রমশ বেড়ে 4° সেন্টিগ্রেড হয়। এই কারণে মাছ এবং অন্যান্য জলচর প্রাণীর শীতপ্রধান দেশে প্রচন্ড শীতের দিনেও বেঁচে থাকতে পারে।
0°C থেকে 10°C উষ্ণতা মাপার জন্য থার্মোমিটারে পারদ এর পরিবর্তে জল ব্যবহার করলে কি হবে?
কোন তরলের আয়তন প্রসারণ নিয়মানুগ হলে সেই তরলকে উষ্ণতা মাপক পদার্থ হিসেবে থার্মোমিটার ব্যবহার করা যায়। উষ্ণতা বাড়লে পারদ এর আয়তন বাড়ে এবং বিভিন্ন উষ্ণতায় পারদ এর প্রসারণের হার প্রায় সর্বত্র সমান। কিন্তু জলের ক্ষেত্রে আয়তন প্রসারণ একটু ভিন্ন ধরনের হয় বা জলের প্রসারণ ব্যতিক্রান্ত প্রসারণ। নির্দিষ্ট পরিমান জলকে 0°C থেকে 4°C উষ্ণতার পাল্লায় উত্তপ্ত করলে জলের আয়তন ক্রমশ কমে যায় এবং 4°C এ সর্বনিম্ন হয়।এরপর উষ্ণতা বাড়ালে জলের আয়তন বাড়ে। এখানে লক্ষণীয় যে, 0°C থেকে 8°C-এ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জলের আয়তন প্রায় সমান। সুতরাং থার্মোমিটার 0°C উষ্ণতায় যে পাঠ দেবে, সেই পাঠ দেবে 8°C উষ্ণতাতেও। সুতরাং 0°C থেকে 10°C পর্যন্ত উষ্ণতা মাপার জন্য থার্মোমিটারে জলকে উষ্ণতা মাপক পদার্থ হিসাবে ব্যবহার করলে উষ্ণতা নির্ধারণে অসুবিধা হবে।