আজ আমরা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের আলোচনা করবো, আজকের বিষয়টি হল পাল বংশ সম্পর্কিত ।
গৌড়রাজ শশাঙ্ক মৃত্যুর পর থেকে পালস শাসনের সূচনা কাল পর্যন্ত সময়ে বাংলায় যে অরাজকতা ও প্রশাসনিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তা ইতিহাসে মাৎস্যন্যায় নামে পরিচিত। প্রায় 650 খ্রিস্টাব্দ থেকে 750 খ্রিস্টাব্দ এই 100 বছর ছিল তার সময়কাল গোপাল 750 খ্রিস্টাব্দ পাল বংশ-এর প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি বাংলার স্থানীয় নেতাদের দ্বারা মনোনীত হয়ে মাৎস্যন্যায় এর অবসান ঘটান।
গােপাল ( 750-770 খ্রি)
গােপাল বাংলার প্রথম নির্বাচিত রাজা। তিনি 750 খ্রিস্টাব্দে সমকালীন বাংলার প্রকৃতিপুঞ্জ বা স্থানীয় দলপতি বা জমিদার এবং কিছু সামন্ত প্রধান কর্তৃক নির্বাচিত হন।
তিনি পাল বংশ-এর প্রতিষ্ঠাতা। এবং শাসনকালে বাংলায় শান্তি স্থাপিত হয়। তিনি অদন্তপুরী মহাবিহার স্থাপন করেন।
তার সমসাময়িক ছিলেন বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তি রক্ষিত।
ধর্মপাল ( 770-810 খ্রি . )
তিনি পাল বংশ-এর প্রকৃত স্থাপয়িতা। তাঁর আমলে বাংলা উত্তর ভারতের শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়। তার পিতা ছিলেন গােপাল ও তিনি ‘পরমেশ্বর পরমভট্টারক’ উপাধি গ্রহণ করেন।
সামরিক কৃতিত্ব:
তিনি প্রতিহাররাজ বৎসরাজ ও তার পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্টের হাতে এবং রাষ্ট্রকুটরাজ ধ্রুব ও তৃতীয় গােবিন্দের কাছে পরাজিত হন।
তিনি সাময়িককালের জন্য কনৌজের সিংহাসনে ইন্দ্রায়ুধের স্থানে চ্ন্দ্রয়ুধকে অধিষ্ঠিত করেন। এই সময় কনৌজকে কেন্দ্র করে পাল – প্রতিহার – রাষ্ট্রকূটদের মধ্যে ত্রিশক্তি সংঘর্ষ শুরু হয়।
তিনি কনৌজে একটা দরবারি অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলেন, যেখানে উপস্থিত রাজারা তার বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন বলে জানা যায়।
অন্যান্য অবদান:
তিনি কেদার ( গাড়ােয়াল ) ও গােকর্ণ ( নেপাল ) জয় করেছিলেন। তার সময় রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপােষক হলেও হিন্দু মন্দির নির্মানের জন্য জমিদান করেছিলেন। এছাড়া বিক্রমশীল মহাবিহার, সােমপুর মহাবিহার এবং 50 টি ধর্মশিক্ষার মঠ স্থাপন করেছিলেন। হরিভদ্র নামক জনৈক বৌদ্ধ গ্রন্থকার তাঁর পৃষ্ঠপােষকতা অর্জন করেছিলেন। তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ব্রাম্মণ গর্গ। কবি সােডেল তাকে ‘ উত্তরপথস্বামীন ’ বলে অভিহিত করেন।
দেবপাল ( 810-850 খ্রি.)
পরিচিতি: ধর্মপালের পুত্র দেবপাল ছিলেন তৃতীয় পাল রাজা যাকে পাল বংশ-এর শ্রেষ্ঠ রাজা বলা হয়।
প্রশাসনিক কর্মচারী: দেবপালের সেনাপতি ছিলেন লবসেন বা লৌসেন ( কলিঙ্গ বা আসাম জয়ের কৃতিত্বের অধিকারী )। তার মন্ত্রী কর্মচারী ছিলেন ব্রাহ্ণ দৰ্ভপানি ও তার পৌত্র কেদার মিশ্র।
সামরিক কৃতিত্ব: তিনি গুর্জর – প্রতিহাররাজ প্রথম ভােজ এবং রাষ্ট্রকুটরাজ অমােঘবর্ষকে পরাজিত করেন। তিনি পূর্বে আসাম থেকে পশ্চিমে কাশ্মীর সীমান্ত ও পাঞ্জাব এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। আরব পর্যটক সুলেমান তার সামরিক শক্তির প্রশংসা করেন। তিনি মুঙ্গেরে নতুন রাজধানী নির্মাণ করেন।
ধর্মমত: তিনি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং নালন্দায় মঠ এবং বুদ্ধগয়না মন্দির নির্মাণ করেন। দেবপাল সুবর্ণদ্বীপ তথা সুমাত্রার রাজা বালপুত্রদেবকে নালন্দায় বৌদ্ধপরিব্রাজকদের বসবাসের জন্য একটি বৌদ্ধ মঠ নির্মাণের অনুমতি দেন ও পাঁচটি গ্রাম দান করেন। বৌদ্ধধর্মে পারদর্শী ব্রাক্ষণ ইন্দ্রদেবকে নালন্দায় আচার্য হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন।
পরবর্তী উল্লেখযােগ্য শাসকগণ
নারায়ণ পাল (854-908 খ্রি.)
তিনি অকর্মণ্য, অদক্ষ শাসক ছিলেন এবং ধর্মকর্মেই তিনি বেশি মনােনিবেশ করেছিলেন ৷ রাষ্ট্রকূটরাজ অমােঘবর্ষ এসময় নারায়ণ পালকে পরাজিত করেন এবং তিনি আমােঘবর্যের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন । তিনি কলচুরিরাজ কোক্কল বাংলা আক্রমণ করে প্রচুর সম্পদ লুণ্ঠন করেন। ওড়িশার রাজা রণস্তম্ভ , রাঢ়দেশের কিছুটা অংশ দখল করেন। তার সময় পালরাজ্যের সীমানা হ্রাস পায়।
প্রথম মহীপাল
তিনি দ্বিতীয় পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা নামেও পরিচিত। এসময় পাল শক্তির পুনরুজ্জীবন ঘটে তার উপাধি ছিল ‘পরমেশ্বর পরম ভট্টারক মহারাজাধিরাজ’। এই সময় বাংলা চোল রাজা রাজেন্দ্রচোল বাংলা আক্রমণ করলে প্রথম মহীপাল পালিয়ে যান। 1026 খ্রিস্টাব্দে কলচুরিরাজ বাংলা আক্রমণ করে এবং বারানসী দখল করেন। এই সময়ে ভারতের সুলতান মামুদ একাধিকবার ভারত আক্রমণ করেন। তিনি নিজে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন ও সারনাথে দুটি বৌদ্ধমঠ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হিন্দু মন্দির নির্মাণ করে। তার নামে মহীপাল গীত রচিত হয়েছিল।
দ্বিতীয় মহীপাল (1070-1075 খ্রি)
দ্বিতীয় মহীপালের সময় দিব্য বা দিব্যকের নেতৃত্বে কৈবর্ত বিদ্রোহ হয় এবং তার নেতৃত্বে বরেন্দ্রভূমিতে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। কৈবর্ত বিদ্রোহের কথা জানা যায় “সন্ধ্যাকর নন্দীর” রামচরিত থেকে। যেখানে এই বিদ্রোহকে “অনিকম ধর্মবিপ্লবম” নামে অভিহিত করা হয়েছে।
রামপাল (1077-1130 খ্রি)
রামপালকে তৃতীয় পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিনি কৈবর্ত শাসক দিব্যকে পরাজিত ও নিহত করে বরেন্দ্রভূমি পুনরুদ্ধার করেন। রমাবতিতে তিনি একটি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। তার সভাপতি ছিলেন “রামচরিত” এর রচয়িতা “সন্ধ্যাকর নন্দী”।
পাল বংশের সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্ন উত্তর
“খালিমপুর তাম্রপট” পাল বংশের কোন রাজার সমরকৃতি সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে?- ধর্মপাল
বাংলার পাল বংশের রাজা দ্বিতীয় মহীপাল এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠনকারী কৈবর্ত নেতা ছিলেন- দিব্য।
ওদন্তপুরী মহাবিহার স্থাপন করেন- রাজা গোপাল।
বিক্রমশীলা মহাবিহার প্রতিষ্ঠাতা হলেন- ধর্মপাল।
পাল বংশের কোন রাজা মুঙ্গেরে নতুন রাজধানী নির্মাণ করেন?- দেবপাল।
কে রমাবতিতে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন?- রামপাল।
দেবপাল কোন ধর্মালম্বী ছিলেন- বৌদ্ধ ধর্ম।
সুতরাং বন্ধুরা পাল বংশ সম্পর্কিত ইতিহাস এখানেই শেষ করলাম। পরবর্তীতে আলোচনা করবো সেন যুগ সম্পর্কে ।