নমস্কার প্রিয় পাঠকেরা, আজ আমরা আপনাদের কাছে শেয়ার করছি পাললিক শিলা ( Sedimentary Rocks ) সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য অর্থাৎ ( পাললিক শিলা কাকে বলে , পাললিক শিলার বৈশিষ্ট্য, পাললিক শিলার শ্রেণীবিভাগ ) এই বিষয় থেকেও সরকারী চাকরির পরীক্ষায় সাধারনত প্রশ্ন এসে থাকে । সমস্ত রকম সরকারী চাকরির পরীক্ষার Syllabus কে অনুসরণ করে নোটসটি বানানো হয়েছে। আশা করি এই রকম গুরুত্বপূর্ণ জেনারেল নলেজের মাধ্যমে আপনাদের প্রস্তুতিটা খুব মজবুত করে তুলবেন ।
পাললিক শিলা ( Sedimentary Rocks )কাকে বলে ?
● সংজ্ঞা : স্তরে স্তরে পলিসঞ্চিত হয়ে যে শিলার সৃষ্টি হয় তাকে পাললিক শিলা বলে । স্তরে স্তরে গঠিত হয় বলে পাললিক শিলাকে স্তরীভূত শিলাও বলা হয়।
■ উৎপত্তির কারণ : আবহবিকারের ফলে ভূ – পৃষ্ঠের আগ্নেয় শিলা প্রতিদিন ক্ষয়প্রাপ্ত ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে বালি , কঁাকর ও নুড়িতে পরিণত হচ্ছে । অন্যদিকে বায়ুপ্রবাহ , নদীস্রোত , হিমবাহ , সমুদ্রতরঙ্গ প্রভৃতি এদের পরিবহন করে সমুদ্র হ্রদ বা নদীর তলদেশে পলিরূপে সঞ্চিত করছে । এইভাবে মহাসাগর , সাগর , হ্রদ বা নদীর তলদেশে দীর্ঘকাল ধরে বিপুল পরিমাণ পলি সঞ্চিত হলে ধীরে ধীরে নীচের পলিস্তরগুলো ওপরের ভারী জলভাগ পলিরাশির চাপে এবং নীচের তাপে জমাট বেঁধে কঠিন শিলায় পরিণত হয় । পলি জমাট বেঁধে তৈরী হয় বলে এই শিলাকে পাললিক শিলা ( Sedimentary Rocks ) বলে। বা পাললিক শিলা হ’ল এক প্রকারের শিলা যা ছোট ছোট কণা জমে বা জমা করে এবং পরবর্তীকালে পৃথিবীর পৃষ্ঠে সমুদ্রের তলে বা জলের অন্যান্য দেহের খনিজ বা জৈব কণার সিমেন্টেশন দ্বারা গঠিত হয়।
● উদাহরণ : বেলেপাথর , নুড়িপাথর , কাদাপাথর , চুনাপাথর , ডলোমাইট , সৈন্ধব লবণ প্রভৃতি পাললিক শিলার উদাহরণ ।
পাললিক শিলার বৈশিষ্ট্য :
(১) বহুদিন ধরে সমুদ্রের তলায় স্তরে স্তরে পলি সঞ্চিত হয়ে গঠিত হয় বলে এই শিলার স্তরগুলো স্পষ্ট বোঝা যায় ;
(২) এই শিলার মধ্যে জীবাশ্ম পাওয়া যায় ;
(৩) কোমল বলে এই শিলা তুলনামূলকভাবে দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ;
(৪) আগ্নেয় শিলার তুলনায় এই শিলা হাল্কা ;
(৫) এই শিলার মধ্যে স্ফটিক থাকে না ;
(৬) পাললিক শিলা সাধারণত কেলাসিত হয় না ;
(৭) সছিদ্রতা পাললিক শিলার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ;
(৮) পাললিক শিলা জৈব উপাদানে গঠিত হয় বলে সাধারণত পাললিক শিলার স্তরের মধ্যেই কয়লা , প্রাকৃতিক গ্যাস , খনিজ তেল পাওয়া যায় ।
পাললিক শিলা ( Sedimentary Rocks )র শ্রেণীবিভাগ:
পাললিক শিলাকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় , যেমন :
(ক) উৎপত্তির কারণ অনুসারে এবং
(খ) পলির উৎপত্তি অনুসারে।
>>উৎপত্তির কারণ অনুসারে পাললিক শিলার শ্রেণীবিভাগ
উৎপত্তির কারণ ও গঠন অনুসারে পাললিক শিলাকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয় , যথা :
(ক) সাধারণভাবে ও যান্ত্রিক উপায়ে গঠিত পাললিক শিলা ,
(খ) জৈব পদার্থ থেকে উৎপন্ন পাললিক শিলা এবং
(গ) রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন পাললিক শিলা ।
(ক) সাধারণভাবে এবং যান্ত্রিক উপায়ে গঠিত পাললিক শিলা: ভূ – পৃষ্ঠের নানা রকম সরু ও মোটা দানার শিলাচূর্ণ ( পলি , বালি , নুড়ি প্রভৃতি ) এবং লোহা ও চূণ জাতীয় পদার্থ হিমবাহ , বায়ু , নদী বা সাগর তরঙ্গের দ্বারা অপসারিত হয়ে সমুদ্র , নদী বা হ্রদে স্তরে স্তরে জমাট বেঁধে কঠিন হয়ে এই জাতীয় পাললিক শিলা গঠন করে । বেলেপাথর , নুড়িপাথর , কাদাপাথর প্রভৃতি এই জাতীয় পাললিক শিলার উদাহরণ ।
● যান্ত্রিক উপায়ে গঠিত পাললিক শিলার শ্রেণী বিভাগ : শিলার আকৃতি ও আয়তন অনুসারে যান্ত্রিক উপায়ে উৎপন্ন পাললিক শিলাকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায় , যথা :
- বালিময় পাললিক শিলা : যে পাললিক শিলা ছোট ছোট শিলাচূর্ণ ( ০.০৬-২.০০ মিলিমিটার ব্যাস সম্পন্ন ) বা বালি থেকে উৎপন্ন হয় , তাকে বালিময় পাললিক শিলা বা এ্যারিনাসিয়াস বলে ( যেমন : বেলেপাথর ) । এই জাতীয় শিলা সাধারণত নরম ও সছিদ্র হলেও সিলিকা দিয়ে তৈরী বেলেপাথর খুব শক্ত হয় । ছোট ছোট নুড়ি , বালি প্রভৃতি যখন জমাট বাঁধে তখন তাকে গ্রিট বলে।
- প্রস্তরময় পাললিক শিলা : যে পাললিক শিলা তুলনামূলক ভাবে বড় শিলা চূর্ণ ( ২.০০ মিলিমিটার বা তার বেশী ব্যাসের নুড়ি ) , গণ্ডশিলা প্রভৃতি জমাট বেঁধে উৎপন্ন হয় , তাকে প্রস্তরময় পাললিক শিলা বলে । সাধারণত সমুদ্রোপকূলের কাছে এই জাতীয় শিলা বেশী দেখা যায় ( উদাহরণ : কংগ্লোমারেট ) । এইধরনের পাললিক শিলা যখন কোণ বিশিষ্ট নুড়ি পাথর জমে উৎপন্ন হয় তখন তাকে ব্রেকসিয়া বলে ।
- কাদা জাতীয় পাললিক শিলা : যে পাললিক শিলা সমুদ্রের গভীর অংশে অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ণ পলি , খুবই ছোট ছোট শিলা চূর্ণ ( ০.০৬ মিলিমিটারের কম ) , কাদা প্রভৃতি জমাট বেঁধে উৎপন্ন হয় , তাকে কাদা জাতীয় পাললিক শিলা বা আর্জিলাসিয়াস বলে ( উদাহরণ : কাদাপাথর , শেল প্রভৃতি ) ।
[খ] জৈব পদার্থ থেকে উৎপন্ন পাললিক শিলা বা জৈবশিলা : সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদসমূহের দেহাবশেষ বা জীবাশ্ম সমুদ্রের নীচে স্তরে স্তরে জমে কঠিন হয়ে জৈব পাললিক শিলা গঠন করে । সামুদ্রিক উদ্ভিদের দেহস্থিত কার্বন জমাট বেঁধে কয়লা উৎপন্ন হয় । এছাড়া কোন কোন সামুদ্রিক প্রাণীর দেহ চুণজাতীয় পদার্থ দিয়ে গঠিত সমস্ত প্রাণীদের দেহাবশেষ জমাট বেঁধে চুনা পাথর উৎপন্ন হয় । ডায়াটম , রেডিও ল্যারিয়ন প্রভৃতি সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও নানান রকম প্রবালের দেহ বালি জাতীয় পদার্থ দিয়ে গঠিত হয় , এই সব বালিকণা জমাট বেঁধে ওপেল শিলার সৃষ্টি করে । কয়লা ও চুনাপাথর এই জাতীয় শিলার উদাহরণ । কয়লার মধ্যে উদ্ভিদের জীবাশ্ম এবং চুনাপাথরের মধ্যে জীবজন্তুর অস্থি পাওয়া যায়।
স্তরে স্তরে সঞ্চিত হওয়ার সময় ফ্লোরা – মিনি – ফ্লোরা নামে এক রকম সামুদ্রিক কীট পাললিক শিলা স্তরে চাপা পড়ে যায় । নানান রকম জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এদের দেহ নিঃসৃত নির্যাস হাইড্রোজেন ও কার্বনের দ্রবণে পরিণত হয়ে খনিজ তেল সৃষ্টি করে । এই জন্য খনিজ তেলকে শিলা তেল বলে ।
[গ] রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন পাললিক শিলা : অনেক সময় নানান রকম রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় শিলা দ্রবীভূত হয় । দ্রবণের জল বাষ্পীভূত হলে শিলার দ্রবণ জমাট বেঁধে পাললিক শিলায় পরিণত হয় । সমুদ্রে এইভাবে সৃষ্টি হওয়া পাললিক শিলাকে সাধারণ ভাবে এভাপোরাইট বলে । উত্তর – বাংলায় জলপাইগুড়ি জেলার মহাকাল নামে গুহায় এই দ্রবীভূত ডলোমাইটকে থামের আকারে জমে থাকতে দেখা যায় । চুনাপাথর , ফটকিরি , সোহাগা , ডলোমাইট ও সৈন্ধব লবণ ( Rock Salt ) , ব্লক জিপসাম ( Rock gypsum ) প্রভৃতি হল রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন পাললিক শিলার উদাহরণ । পশ্চিমবাংলার বর্ধমান , পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলায় বেলেপাথর ও কয়লা এবং জলপাইগুড়ি জেলায় ডলোমাইট পাওয়া যায় ।
>>পলির উৎপত্তি অনুসারে পাললিক শিলার শ্রেণীবিভাগ
পলির উৎপত্তি অনুসারে পাললিক শিলাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় , যথা :
(১) সংঘাত শিলা বা ক্লাসটিক রক এবং
(২) অসংঘাত শিলা বা নন্ ক্লাসটিক রক
[ক]সংঘাত শিলা বা ক্লাসটিক রক : ( গ্রীক ভাষায় ক্লাসটিক শব্দের মানে হল ভগ্ন ’ । যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আদি শিল্প চূর্ণ – বিচূর্ণ হয়ে যে সমস্ত পাললিক শিলা সৃষ্টি হয় , তাদের সংঘাত শিলা বলে । ( বেলেপাথর , নুড়িপাথর , কাদাপাথর প্রভৃতি সংঘাত শিলার উদাহরণ। বেলেপাথর নানান রঙের হয় , যেমন : রাজস্থানের সোনার কেল্লা দুর্গটি হলুদ বেলেপাথর এবং দিল্লীর লালকেল্লা দুর্গটি লার্ল বেলেপাথর দিয়ে তৈরী ।
[খ] অসংঘাত শিলা বা নন – ক্লাসটিক রক : যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি না হয়ে যেসব পাললিক শিলা রাসায়নিক পদ্ধতিতে তৈরি হয় , তাদের অসংঘাত শিলা বলে । এই জাতীয় শিলা প্রকৃতিতে সাধারণত নরম হয় । চুনাপাথর , ডলোমাইট প্রভৃতি হল অসংঘাত পাললিক শিলার উদাহরণ চক , মার্ল , ককুইনা , উলিটিক প্রভৃতি নানান ধরণের চুনাপাথর দেখা যায়।
♦জীবাশ্ম কাকে বলে ?
জীবদেহ যখন পাথরে পরিণত হয় , তখন তাকে জীবাশ্ম বলে ( জীব + অশ্ম = জীবাশ্ম ; অশ্ম = পাথর ) । পাললিক শিলা গঠনকালে অনেক সময় মৃত সামুদ্রিক প্রাণী , উদ্ভিদ প্রভৃতির দেহ চাপা পড়ে প্রস্তরীভূত হয়ে যায় এবং পাথরের স্তরের মধ্যে তার ছাপ থেকে যায় । এইভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহ পাথরে পরিণত হলে তাকে জীবাশ্ম বলে ।
♦পাললিক শিলার স্তরের মধ্যে জীবাশ্ম পাওয়া যায় কেন ?
নদী , সমুদ্র বা হ্রদের তলায় স্তরে স্তরে পলি জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের দেহও তার মধ্যে চাপা পড়ে । পলি জমাট বেঁধে পাথরে পরিণত হওয়ার সময় এইসব উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহও আস্তে আস্তে জমাট বেঁধে পাথরে পরিণত হয়ে জীবাশ্ম সৃষ্টি করে শিলাস্তরের ওপর তার ছাপ দেখা যায় । এইজন্য জীবাশ্ম কেবল পাললিক শিলাতেই দেখতে পাওয়া যায় । জীবাশ্ম পৃথিবীর আদিকালের জীবজগৎ সম্পর্কে গবেষণার পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
আজকের পৃথিবীর উচ্চ পর্বতগুলি ( হিমালয় , অ্যান্ডিজ , রকি প্রভৃতি ) যে এককালে সমুদ্রের নীচে জমে থাকা পলি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল , ভূ – তত্ত্ববিদেরা তা ঐ সমস্ত পর্বতের পাললিক শিলা থেকে পাওয়া জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবাশ্ম থেকে প্রমাণ করেছেন ।
Covered Topic : পাললিক শিলা কাকে বলে , পাললিক শিলা কাকে বলে উদাহরণ দাও, পাললিক শিলার বৈশিষ্ট্য, পাললিক শিলার শ্রেণীবিভাগ, পাললিক শিলায় জীবাশ্ম দেখা যায় কেন, পাললিক শিলায় জীবাশ্ম দেখা যায় কেন, পাললিক শিলার উদাহরণ, প্রস্তরময় পাললিক শিলার উদাহরণ, শিলার প্রকারভেদ।
Pingback: রূপান্তরিত শিলা (Metamorphic Rocks) কাকে বলে? রূপান্তরিত শিলার বৈশিষ্ট্য – Studious